বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: নগদের মাধ্যমে সরকারি ভাতার ১৭১১ কোটি টাকা উধাও

প্রকাশিত : ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, ১২ জুন ২০২৫ বৃহস্পতিবার ৫৮ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান নগদ লিমিটেড এর বিরুদ্ধে এবার ভয়াবহ আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে, যা প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতির এক নজিরবিহীন চিত্র তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশদ তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের জন্য প্রেরিত ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকার ভাতা ৪১টি অননুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই বিপুল অর্থ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে।

জালিয়াতির নানা কৌশল: ই-মানি জাল, ভুয়া অ্যাকাউন্ট, ভুয়া রিপোর্টিং পোর্টাল
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগদ কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে। এসব ই-মানির কোনো রিয়েল মানি সাপোর্ট ছিল না, ফলে সরকার সরাসরি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি একটি জাল রিপোর্টিং পোর্টাল তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক বিভাগকে বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করেছে। তদন্তে জানা গেছে, এই রিপোর্টিং পোর্টালটির কোনো সংযোগ ছিল না মূল সার্ভারের সঙ্গে—যার মাধ্যমে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা।

এরই মধ্যে নগদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অপরাধে মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক অনুমোদন ছাড়াই এমএফএস পরিচালনার অধিকার পায় নগদ
নগদ ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে। তবে ব্যাংক অনুমোদন ছাড়াই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (বর্তমানে নগদ লিমিটেড) কে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নজরদারিহীনতা সৃষ্টি হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

নগদের অর্থ ও মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, নগদ লিমিটেডের মালিকানা স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও বহুবিধ অনিয়ম হয়েছে। প্রথমে ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৫০০ কোটি টাকায় শেয়ার কিনলেও পরে তা বিক্রি করে দেওয়া হয় সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের কাছে।

পরবর্তী সময়ে, ৭০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয় ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে, যা মানি লন্ডারিং ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের পরিপন্থী বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সিস্টেম জটিলতা ও নিরাপত্তার অভাব
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, নগদের ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার সিস্টেম অত্যন্ত সেকেলে, যা আন্তর্জাতিক মান পূরণে ব্যর্থ। সিস্টেম লগ না থাকায় জালিয়াতির কোনো ডিজিটাল ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহ সম্ভব নয়।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, নগদ কর্তৃপক্ষ লাইভ তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়, যা স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

আদালতের স্থগিতাদেশের সুযোগে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলো মামলার আসামিরা
৭ই মে ২০২৫ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালত বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত প্রশাসক দলের কার্যক্রমে স্টে অর্ডার জারি করে। এর ফলে প্রশাসক দল নগদ পরিচালনায় আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এই সুযোগে, নগদের সাবেক এমডি ও মামলার অন্যতম আসামি তানভির আহমেদ মিশুক নিজেকে পুনরায় এমডি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং আরেক মামলার আসামি শাফায়েত আলমকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেন।

চাঞ্চল্যকরভাবে, এ নিয়োগ ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই করা হয়েছে এবং তারা আবারও নগদের আর্থিক ও প্রযুক্তি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এতে গ্রাহকের অর্থ ও তথ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রশাসক দলের আইটি অ্যাক্সেস, ই-মেইল এবং ই-মানি সম্পর্কিত সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করে দেওয়ায় তারা কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে।

অডিট কার্যক্রমেও বাধা
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম কেপিএমজি-এর কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রশাসক দলের সিস্টেম লগইন, ই-মেইল, পাসওয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়ায় বর্তমানে অডিট কার্যক্রম প্রায় স্থগিত।

নগদের মাধ্যমে সরকারি ভাতা আত্মসাতের এই ঘটনা শুধু আর্থিক নয়, প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত এবং নৈতিক ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সরকারি অর্থের সুরক্ষা, গ্রাহকের আস্থা এবং ডিজিটাল লেনদেনের নিরাপত্তা—সবই এখন প্রশ্নের মুখে। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও অশনিসংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT