সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অতীতে এ ধরনের বন্যায় সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এবার তা দেখা যাচ্ছে না।
পানিবন্দি মানুষের অভিযোগ, সরকারি ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ইতোমধ্যে বন্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ) উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা ও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. কামরুল ইসলাম।
নিকট-অতীতের বন্যায় দেখা গেছে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। অনেককে বন্যার পানিতে নেমে দুর্গতদের বাসা-বাড়িতে গিয়ে তৈরি খাবার, বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দিতে দেখা গেছে।
অনেককে নৌকা ও স্পিডবোটে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মেডিকেল টিম গঠন করে দুর্গত এলাকার রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বোতলজাত খাবার পানি বিতরণ করেছে অনেকেই।
এমনকি বন্যা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো ব্যাপকভাবে অবদান রেখেছে। যারা ঘর হারিয়েছে তাদের ঘর তৈরির যাবতীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। যাদের পুকুর-ঘেরের মাছ বিনষ্ট হয়েছে তাদের পুনরায় মাছ চাষের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
চাষাবাদের উপকরণ বিনষ্ট ও গরু মারা গেছে যাদের তাদের গরু ও চাষাবাদের উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
কিন্তু এবারের বন্যায় রাজনৈতিক সংগঠনের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ত্রাণ তৎপরতা দেখা যায়নি। এমনকি সামাজিক সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসেনি।
সরকারের বাইরে রাজনৈতিক ও সমাজিক সংগঠনগুলো ত্রাণ তৎপরতায় না থাকা প্রসঙ্গে সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থপানা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসিন বলেন, জাতি হিসাবে আমরা বেশ পরোপকারী। একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে। সবাই মিলে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই বলে বিশ্বে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল। কথা হচ্ছে, আমাদের সেভাবে দাঁড়াতে হবে। স্থানীয়ভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করতে হবে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ত্রাণ তৎপরতায় সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ঈদের আগে থেকেই আমরা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। ঈদের পর প্রথম কর্মদিবসে প্রতিমন্ত্রী ও আমি সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলা সফর করি এবং ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দিই। স্থায়ী বরাদ্দের পাশাপাশি বিশেষ বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে।
পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী, নগদ অর্থ এবং খাদ্যদ্রব্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত আছে। চাহিদা মোতাবেক বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে বেসরকারি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি কিংবা সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা নেই কেন সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ত্রাণ সচিব।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগে এ পর্যন্ত নগদ ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টন। ২১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া শিশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য ৩৫ লাখ টাকা এবং পশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য ৩৫ লাখ টাকা করে পৃথক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এসব বরাদ্দের মধ্যে সিলেট জেলার জন্য ২০ লাখ টাকা, ৫০০ টন চাল, ৫০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, পশুখাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার জন্য একই পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ, শুকনো খাবার ও চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জ জেলার জন্য ১০ লাখ করে নগদ টাকা, ২০০ টন করে চাল, ৩ হাজার প্যাকেট করে শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকা করে শিশুখাদ্য এবং ৫ লাখ টাকা করে পশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য নগদ ১০ লাখ টাকা, ১০০ টন চাল এবং ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আকস্মিক এ বন্যায় এরই মধ্যে ২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ লাখ ৭২ হাজারের বেশি শিশু। তাদের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্যার পানি বৃদ্ধির সময় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ডুবে মারা যাওয়া, অপুষ্টি ও মারাত্মক পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়া, বাস্তুচ্যুতির আতঙ্ক এবং জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রে নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সংস্থাটির তরফ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং মাঠপর্যায়ের পার্টনারদের সমন্বয় ও অংশীদারত্বে আমরা ৫ দিনে প্রায় ১ লাখ বন্যাকবলিত মানুষের কাছে নিরাপদ পানি বিতরণ করেছি এবং এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকাকালীন ৩ হাজারের বেশি ১০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পানির পাত্র বিতরণ করেছি। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলে তা মোকাবিলায় আমরা বিভিন্ন গুদাম থেকে অতিরিক্ত জরুরি সরঞ্জাম আনছি।