anusandhan24.com
১২৪ প্রাণেও নিরাপদ হয়নি পুরান ঢাকা
সোমবার, ৩ জুন ২০২৪ ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ণ
anusandhan24.com anusandhan24.com :

‘মামা, বাড়িতে আগুন লাগছে, আমাদের বাঁচাও’– ফোনে ভাগনির এমন আকুতি শুনে দ্রুত পল্টন থেকে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ছুটে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রাজ। কিন্তু সেখানে তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। তিনি নিজের বাড়িতে ঢোকার উপায় পাচ্ছিলেন না। শেষে বাড়ির পেছনের পথে গিয়ে বোন মাহমুদা বেবীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। যদিও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। শুধু বোনই নয়, ওই রাতের বিভীষিকায় আপন ভাই, ফুপাতো বোন, চাচিসহ ১৫ স্বজনকে হারান রাজ। তিনি বেদনাহত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমরা সব হারাইলাম; কিন্তু কিছুই বদলায় নাই। সব আগের মতোই চলতেছে।’

নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৪ বছর পূর্ণ হলো। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটারার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। মুহূর্তে ভয়াবহ আকার ধারণ করে আগুন। এতে ১২৪ জন পুড়ে মারা যান। দগ্ধ আরও কয়েকশ মানুষ দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে যান। তবে তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শরীরে নিয়ে বেড়াচ্ছেন আগুনের ক্ষত।

মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর পুরান ঢাকার মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে ওঠা রাসায়নিক গুদাম-কারখানা সরানোর দাবি ওঠে। এ লক্ষ্যে গঠিত হয় দুটি কমিটি। তারা কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে গুদাম-কারখানা স্থানান্তরের সুপারিশ করেন। একটি রিপোর্টে বলা হয়, ২ হাজার ৭৯টি রাসায়নিক গুদামের মধ্যে ৮০০ ছিল বৈধ। তবে এত বছরেও গুদামগুলো সরানো হয়নি। নেওয়া হয়নি স্থানীয় মানুষের জন্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ। আর ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।

স্বজন হারানো মোহাম্মদ রাজ জানান, ওই রাতের দুঃসহ অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এখনও তিনি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। স্বজন হারানোর শোক তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। অগ্নিকাণ্ডে ছেলেমেয়ের মৃত্যুতে প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন তাঁর বাবা সাদেক মিয়া ও মা হামিদা বেগম। সেই শোক বয়ে বেড়াতে বেড়াতে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাদেক মারা যান। আর হামিদা সারাক্ষণ কাঁদেন। অবুঝের মতো বলেন, ‘আমার পোলা-মাইয়া কই গেল? অগোরে আইনা দাও।’

রাজ জানান, আগুনে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাত-আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এমন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অনেক। কিন্তু মৃতদের পরিবারকে শুধু এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেউ কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

নবাব কাটারা সমাজকল্যাণ সংগঠন ও পঞ্চায়েতের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক উদ্দিন বুলু বলেন, শুধু সম্পদের ক্ষতিই নয়, আগুনে যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি সরকার। এমন অনেকে মারা গেছেন, যে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সেই পরিবারগুলো কীভাবে চলছে, তার খোঁজ কেউ রাখেনি। তাদের পুনর্বাসন দরকার ছিল। এমন অনেক দাবি আমরা তুলেছি। ৩ জুনকে নিমতলী ট্র্যাজেডি দিবস হিসেবে সরকারি উদ্যোগে পালনের আহ্বান জানিয়েছি। বছরের পর বছর এসব বলতে বলতে সবাই ক্লান্ত। দায়িত্বশীলদের কোনো হেলদোল নেই।

জানা যায়, এত মানুষের প্রাণ ও সম্পদহানির ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শুধু বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। সেটিরও কোনো তদন্ত হয়নি। বংশাল থানার ওসি মঈনুল ইসলাম বলেন, আমি যতদূর জানতে পেরেছি, ওই জিডিমূলে মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়েছিল। এমনিতে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে সেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুপারিশ ছিল না। মামলা না হওয়ায় ওই ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ।

সেদিন নিমতলীর ঘটনাস্থলে এক বাড়িতে দুই বোন সাকিনা আক্তার রত্না ও উম্মে ফারিয়া আক্তার রুনা এবং পাশের বাড়িতে তাদেরই আরেক বোন আসমা আক্তারের বিয়ের আয়োজন চলছিল। বিয়ের রান্নার স্থানের পাশেই ছিল রাসায়নিকের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা রাসায়নিকের প্লাস্টিকের ড্রাম গলে যায়। এতেই মারাত্মক আকার ধারণ করে আগুন। মুহূর্তে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন আগুনে মা-বাবা হারান তিন কন্যা। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃস্নেহে গণভবনে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।