
anusandhan24.com :
পথে পথে লেজারের আলোর ইশারা। কোথাও পুলিশ, কোথাও আগ্রাসী যুবকের দল। ইশারার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে না নামলেই শুরু হয় হুমকি-ধমকি। ট্রাক আটকিয়ে নামানো হয় হেলপারকে। ধরিয়ে দেওয়া হয় চাঁদার রসিদ। ইজারাদার, পরিবহণ কোম্পানি ও বিভিন্ন সমিতির নামে ছাপানো এসব রসিদে লেখা থাকে টাকার পরিমাণ। এরপর টাকা দেওয়ার পালা। টাকা দিলেই চাকা ঘোরানোর অনুমতি মেলে। সবজির ট্রাকে হেলপার সেজে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে ঢাকার কাওরান বাজারে আসতে প্রতিবেদকের সামনে অন্তত সাতটি স্পটে চাঁদাবাজির এমন সব চিত্র ধরা পড়ে।
মঙ্গলবার বিকালে মহাস্থানগড় হাট থেকে ট্রাকে কাওরান বাজারের পথে রওয়ানা হন এই প্রতিবেদক। ট্রাকভর্তি বেগুন, পটোল, করলা, শসা, মুলা, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচামরিচসহ সাড়ে ৯ টন সবজি। ট্রাকচালক ইব্রাহিম মিয়া ও তার সহকারী আলী আমজাদ। মহাস্থানগড় হাট থেকে বিকাল পৌনে ৫টায় শুরু হয় যাত্রা।
রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক ধরে বগুড়ার তিনমাথা এলাকায় পৌঁছাতেই এক যুবক গাড়ি থামিয়ে ১০০ টাকা চান। চালক ওই যুবককে সাংকেতিক ভাষায় বললেন, ‘বগুড়ার মালিকের গাড়ি’। অর্থাৎ চাঁদা আগেই পরিশোধ করা আছে। এরপর মেলে গাড়ি চলার অনুমতি। কিসের চাঁদা জিজ্ঞেস করলে ইব্রাহিম মিয়া বললেন, আগে তো বগুড়ায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, মালিক সমিতি, চালক সমিতিসহ বিভিন্ন নামে-বেনামে চাঁদা আদায় করা হতো। র্যাবের অভিযানের পর এসব এখন বন্ধ। ‘চাঁদা-ফাদা’ এখন কেউ নেয় না। তবে তিনমাথা এলাকায় বগুড়ার বাইরের গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয় সার্জেন্টের নামে। চাঁদা না দিলে ওইসব গাড়িকে সার্জেন্ট ডেকে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।
চাঁদাবাজির এমন সব গল্প শুনতে শুনতে রাত সাড়ে ৮টায় ট্রাকটি পৌঁছায় সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়ে। হঠাৎ লেজার লাইটের আলোর ইশারা। ড্রাইভার ইব্রাহিম মিয়া বললেন, ‘পুলিশ গাড়ির কাগজপত্র চেক করতে সিগন্যাল দিচ্ছে।’ জেলা পুলিশ কিনা জানতে চাইলে বললেন, ‘না… না… হাইওয়ে পুলিশ। আরে চেক-টেক কিছুই না, এইডা চান্দা নেওয়ার ধান্ধা।’ সিগন্যালের সঙ্গে সঙ্গেই হেলপার আলী আমজাদ গাড়ির কাগজপত্রের ছোট একটি ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলেন। প্রায় ৬-৭ মিনিট পর ফিরে এলেন হেলপার আমজাদ। বললেন, ‘গাড়ি ছাড়েন ওস্তাদ। ৩০০ (টাকা) তেই কাজ হয়েছে। আর সমস্যা নাই।’
প্রায় ৫০ মিনিট পর ট্রাকটি বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা সেতু) পশ্চিম প্রান্তের টোল প্লাজায় পৌঁছানোর আগেই তিনজন পুলিশ সদস্য ট্রাকটিকে সিগন্যাল দিলেন। এবারও হেলপার আলী আমজাদ নেমে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘১০০ টেকা লিচে (নিয়েছে)।’ গাড়ি চলতে শুরু করলে আমজাদ বললেন, ‘১০০ টেকা স্যারের চা-পানের খরচ।’ কথায় কথায় যমুনা সেতু পার হয়ে যায়। এবার ইব্রাহিম মিয়া কিছুটা খুশি। কারণ হিসাবে জানালেন, এই পারেও একইভাবে ১০০-১৫০ টাকা নেয় পুলিশ। প্রথম রমজান হওয়ায় হয়তো দাঁড়ায়নি। টাকাটা বেঁচে গেল।
টাঙ্গাইল বাইপাস মোড়ে ফের লেজারের ইশারা। দেখা মিলল এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের। যথারীতি ট্রাক থেকে নেমে গেলেন আলী আমজাদ। ফিরে এসে জানালেন, আড়াইশ টাকা নিল। রাত সাড়ে ১১টায় চন্দ্রায় ঠিক একইভাবে ট্রাকটি থামানো হলো। এবার এক পুলিশ সদস্য নিলেন ৫০ টাকা। চন্দ্রা থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত ছিল না লেজারের ইশারা। ট্রাকচালক ইব্রাহিম মিয়া জানালেন, এই এলাকায় চাঁদাবাজবিরোধী অভিযান চালিয়েছে র্যাব। এরপর থেকে চাঁদাবাজদের নিয়মিত দেখা যায় না।
তবে ফাঁকে ফাঁকে তারা চাঁদা তোলে। যখন চাঁদা তোলা হয় তখন এই এলাকার তিনটি স্থানে ২৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরমধ্যে বাইপাইলে ট্রাফিক পুলিশকে ১০০ টাকা, সাভার বাসস্ট্যান্ডে ৫০ টাকা এবং গেন্ডায় পৌরসভার নামে ১০০ টাকা।
রাত ১টায় ট্রাকটি ঢাকায় ঢুকতেই গাবতলীর মাজার রোড এলাকায় গতিরোধ করা হয়। সিটি করপোরেশনের নামে দুজন ১০০ টাকা চাঁদা নেয়। তবে তারা কোনো রসিদ দেয়নি। এরপর রাত দেড়টার পর কাওরান বাজারে ঢোকে ট্রাকটি। এখানে ধাপে ধাপে নেওয়া হয় ৫০০ টাকা চাঁদা। এভাবে সব মিলিয়ে সাতটি স্পটে একদিনে এই ট্রাকটিকে গুনতে হয় ১৪শ টাকা। তবে যেসব স্পটে লোক ছিল না সেগুলো যোগ হলে এই চাঁদার পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় দুই হাজার টাকা।
ট্রাক থেকে চা খেতে খেতে কথা হয় ড্রাইভার ইব্রাহিম ও হেলপার আমজাদের সঙ্গে। তারা আক্ষেপের সুরে বলেন, শুধু এই চাঁদাগুলো বন্ধ করা গেলে রাস্তায় চলাচল কত সহজ হয়ে যেত! যেখানেই যাবেন, যেই রাস্তাতেই যাবেন শুধু এমন চাঁদা আর চাঁদা। কথা বলতে বলতেই চাঁদা আদায়ের পরিস্থিতি বোঝাতে পকেট থেকে দুটি রসিদ বের করলেন। এর একটি বরগুনা পৌরসভার নামে ৫০ টাকা, আর একটি পার্বতীপুর পৌরসভার নামে ৫০ টাকা।
একই পরিস্থিতির কথা জানালেন অন্য ট্রাক ড্রাইভাররাও। ইব্রাহিমের ট্রাকে ঢাকা আসার আগে মহাস্থানগড় বাজারে কথা হয় ট্রাকচালক ঈসা মিয়ার সঙ্গে। তিনি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ঢাকা থেকে সবজির ট্রিপ আনতে প্রায়ই তিনি যান মহাস্থানগড় হাটে। তিনি জানান, মহাস্থানগড় থেকে ১২ টন সবজি নিয়ে কাওরান বাজারে আসা একটি ট্রাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। ট্রাকে মাল ওঠানোর আগে মধ্যস্থতাকারীকে (দালাল) দিতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এছাড়া প্রায় আড়াইশ কিলোমিটারের এই পথে অন্তত আরও ৭টি স্থানে দিতে হয় ১২৫০ টাকা চাঁদা। চাঁদা দিতে দিতে আমরা রীতিমতো হয়রান।
আরেকটি তথ্য মেলে ঈসা মিয়ার কাছ থেকে। তিনি জানান, এই চাঁদার বাইরেও ট্রাক চালাতে বিশেষ টোকেন নিতে হয়। বড় ট্রাক মাসে ২০০০ টাকা। ছোট ট্রাক ১০০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাক দেড় হাজার টাকা। তবে এই টোকেন নেওয়া জরুরি। এটা না থাকলে পদে পদে হয়রানি হতে হবে। তার দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে অন্য চালকদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মেলে।
একজন ট্রাকচালক জানান-ঢাকা, হেমায়েতপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের দালাল নিযুক্ত রয়েছে। তারা মাসে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে টোকেন দিয়ে থাকেন। ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ি ধরলে ওই টোকেন দেখালেই গাড়ি ছেড়ে দেন। বিভিন্ন সংকেত দিয়ে টোকেন তৈরি করা হয়। বর্তমানে চলছে, আরাফাত মুন্সি, পাখি, মামা-ভাগিনা, বিসমিল্লাহ, দেশমাটি ট্রান্সপোর্টসহ আরও কয়েকটি টোকেন। প্রতি দু-এক মাস পরপর টোকেনের নাম পরিবর্তন করা হয়।
মহাস্থানগড় বাজারে পরিবহণ ঘিরে ৪০ চাঁদাবাজ : মহাস্থানগড় হাটবাজার থেকে সবজি যায় ঢাকার কাওরান বাজার, চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজার, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সবজি ও কাঁচামাল নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ট্রাকচালকরা এখানে এসে ভিড় করেন। আর তাদের ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ৪০ চাঁদাবাজ। স্থানীয়রা এদের দালাল হিসাবে চেনেন। এরা মালামাল ভাড়া করার নাম করে ট্রাকচালকদের কাছ থেকে ১০০০ থেকে ২০০০ করে টাকা হাতিয়ে নেন। চাঁদাবাজ সবুজের সঙ্গে কথা হয় । তিনি জানান, আগে তারা ১২ জন ছিলেন। এখন বাড়তে বাড়তে ৪০ জন হয়েছেন। এতে আগের চেয়ে ইনকাম অনেকটা কমে গেছে। সবুজ জানান, দালাল (চাঁদাবাজ) খাজাসহ বেশ কয়েকজন এই কাজ করে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়ে গেছেন। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, খাজা মিয়া মহাস্থানগড় হাটের অপর পাশে বিশাল জায়গা নিয়ে আড়তের মতো স্থাপনা করে বসেছেন। সামনে ছোট একটি টেবিল এবং একটি কাঠের চেয়ার। পেছনে একটি চৌকি পাতানো। ওই চৌকিতে গাড়িচালকরা এসে বসেন। খাজার দুটি বাটন মোবাইল ফোনে হরদম ফোন আসছে। আর তিনি চালকদের সঙ্গে সমন্বয় করে দিচ্ছেন। খাজার নিজেরও ট্রাক রয়েছে। এছাড়া তিনি আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন মহাস্থানগড় হাটবাজার শাখার সভাপতি। খাজা মিয়া বলেন, আমি মানুষের সেবা করি, বিনিময়ে আল্লাহ ভালোই দেন। কারও সঙ্গে কোনো জোর-জুলুম করি না।
হাতবদল আর চাঁদায় বাড়ে সবজির দাম : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকদের হাত থেকে আসা সবজি ঢাকায় ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে অন্তত ৫ বার হাতবদল হয়। কৃষক থেকে পাইকার, সেখান থেকে ঢাকার আড়ত, সেখান থেকে ছোট পাইকার, তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা। এরপর ভোক্তার হাত পর্র্যন্ত পৌঁছতে প্রতিটি পর্যায়ে সবজির দাম দ্বিগুণ হচ্ছে।
মহাস্থানগড় বাজারে কথা হয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা জানান, ঝামেলাহীন ব্যবসা করতে পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের (কথিত শ্রমিক) প্রতিনিধিকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। সেই খরচও যুক্ত হয় সবজির দামে।
মহাস্থান বাজারের চিত্র : মঙ্গলবার মহাস্থানগড় হাটে প্রতি মন মুলা বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি, ফুলকপি ৬০০ টাকা, আলু ৫০০-৬০০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৮০০, পেঁয়াজ ২৮০০ টাকা, রসুন ৪২০০ টাকা ও শসা-খিরা ২৫০০ টাকা। এছাড়া তরমুজ ৬০ টাকা কেজি, লাউ ১০ টাকা পিস, বড় সাইজের পাতাকপি ১০ টাকা পিস, ছোট ৫ টাকা, পটোল ৬০ টাকা কেজি, মিষ্টি কুমড়া ১১ টাকা কেজি, লেবু ৮ টাকা পিস, তিন কেজি ধনে পাতা ৪০ টাকা। তবে পাইকাররা জানিয়েছেন, দালালি, গাড়ি ভাড়া, শ্রমিক খরচ সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে তাদের আরও ৫ টাকা বেড়ে যায়।
মহাস্থানগড় হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও রায়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, এই হাটে সবজি নিতে দূর-দুরান্তের মানুষ আসেন। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা এড়াতে আমরা চেষ্টা করি। এরপরও কিছু ঝামেলা আছে। যেগুলো আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।