ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত সরকারের ঋণ নেওয়ার উপকরণ ট্রেজারি বিল ও বন্ড। এ উপকরণে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়পত্র কিংবা ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদ মিলছে। এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সুদহার এখন ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে সুদহার উঠেছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। আবার ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার মতো এ ক্ষেত্রে কোনো কর দিতে হয় না। বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নেই। চাইলেই অন্যের কাছে বিক্রি করা যায়। এসব সুবিধার কারণে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। অন্যদিকে সুদের হার বাড়লেও অনেক ব্যাংক প্রত্যাশিত আমানত পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি পর্যন্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ স্থিতি ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ উল্লেখযােগ্য আকাড়ে বেড়েছে বেলে জানা গেছে। গত জুন পর্যন্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ডে মোট ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের মধ্যে ব্যক্তি বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১ হাজার ১০২ কোটি টাকা।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, গত জুলাই মাসে ব্যাংক ঋণে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ডের প্রতি নিলামে ব্যক্তি পর্যায়ের দু’একটি আবেদন আসত। অনেক নিলামে একটিও আবেদন পাওয়া যেত না। এখন ৮ থেকে ১০টি আবেদন আসছে। বেশির ভাগের ঝোঁক কম মেয়াদের ট্রেজারি বিলে। অনেকে সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তির পর তা ভাঙিয়ে বিল-বন্ডে রাখছেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখছেন অনেকে। মূলত ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন সুবিধার কারণে এমন হচ্ছে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, সাধারণত ট্রেজারি বিল-বন্ডের চেয়ে ব্যাংক আমানতে সুদহার ৫০ পয়সা বা ১ টাকা বেশি থাকে। এখন ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। ঋণে সুদহারের একটা সীমা থাকায় ব্যাংকগুলো চাইলেই আমানতে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মতো সুদ দিতে পারছে না। ফলে আমানত পাওয়া ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের হয়তো আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে কিছু ব্যাংক সংকটে পড়েছে। অবশ্য ঋণের সুদহার প্রতি মাসে বাড়ছে। ফলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটি ঠিক হয়ে যাবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, একজন ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন না। সঞ্চয়পত্র কিনতে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ এবং এর বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয়। এ ছাড়া ১৫ লাখ, ৩০ লাখ ও ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগে তিন ধরনের সুদ দেওয়া হয়। মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙালে সুদহার অনেক কম পাওয়া যায়। এসব কারণে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা কমে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায় নেমেছে। আগের অর্থবছর কমেছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এদিকে ব্যাংকে আমানত রেখে এখন ৯ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ মিলছে। এরপরও গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আমানত ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজার এই ভালো তো এই খারাপ। আবার ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে উৎসে কর কাটা হয়। ১ লাখ টাকার বেশি অঙ্কের জমার ওপর বিভিন্ন হারে আবগারি শুল্ক কাটা হয়। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন চার্জ কেটে নেয়। এ কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে এখন বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। অবশ্য অনেকে বিল ও বন্ডে যে ব্যক্তি বিনিয়োগ করা যায়, তা জানেন না। যারা অবগত, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ অনেকে এখন সরকারি সিকিউরিটিজে টাকা রাখছেন।