
anusandhan24.com :
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি কর্মকাণ্ড বা ভোটের প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। এমন বিধিনিষেধ থাকলেও এবার বহু চিকিৎসক তা মানছেন না। আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সদস্যরা দেশের বিভিন্ন আসনে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোটের প্রচার চালাচ্ছেন। চাকরিবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে উলটো যুক্তি দেখাচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এবার বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে ১৬ চিকিৎসক নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যাদের সবাই স্বাচিপ সদস্য। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসক সংসদ-সদস্য হতে মাঠে নেমেছেন। জানা যায়, এ ১৬ চিকিৎসক ছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পক্ষে ক্যাম্পেইন করছেন অনেক সরকারি চিকিৎসক-নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এছাড়া অনেক চিকিৎসক নৌকাসহ বিভিন্ন প্রতীকের ব্যানারে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইছেন। এতে হাসপাতালে রোগীর সেবায় ভোগান্তি বাড়ছে।
সাধারণ চিকিৎসক-নার্সরা অভিযোগ করছেন, প্রতীক বরাদ্দের পরদিন ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের পাশেই ঢাকার আগারগাঁওয়ের সড়কে মিছিল করেন স্বাচিপের চিকিৎসকরা। অফিস সময়ে চিকিৎসা সেবার ব্যাঘাত ঘটিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানসহ (নিটোর) আশপাশের বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল থেকে এসে তারা এসে মিছিলে যোগ দেন। সরকারের পক্ষে নানা স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি নৌকা মার্কায় ভোট চান তারা। সেই মিছিলের ভিডিও তাদের ফেসুবক পেজেও শেয়ার করেন। অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এর ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। কোনো সহায়তা করতে পারবেন না। এছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’-এর ২০২১ সালের ২৮ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপনের (চ) ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো নির্বাচন বা রাজনৈতিক দলের সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না। বৃহস্পতিবার ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের পক্ষে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ব্লকের অষ্টমতলার কনফারেন্স রুমে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীন চৌধুরী ও স্বাচিপ মহাসচিব কামরুল ইসলাম মিলন বক্তব্য দেন। ডা. মিলন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক হিসাবে এখনো চাকরি করছেন। এ সময় হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
এ ব্যাপারে কথা বলতে কামরুল ইসলাম মিলনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীন বলেন, হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউট জাহাঙ্গীর কবির সাহেবের নির্বাচনি এলাকায় পড়েছে। আমরা অনেকে এ এলাকার ভোটার। সেই হিসাবে তিনি আজ সবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। নির্বাচনি ক্যাম্পেইন করেছেন। হাসপাতালের স্বাচিপ সদস্য চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে আমরা কারও পক্ষে ভোট চাইনি।
এদিকে দেখা যায়, আগারগাঁওয়ে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিভাজকে ঢাকা-১০ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ভোট চেয়ে ফেস্টুন টানানো হয়েছে। এসব ফেস্টুনে নাম আছে স্বাচিপের সহসভাপতি মো. আবু রায়হানের। তিনি শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী সায়মা আফরোজ নির্বাচনি এলাকাতেই চাকরি করেন। তিনি আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। সায়মা তার স্বামীর পক্ষে প্রকাশ্যেই প্রচার চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ২৪ ডিসেম্বর তাকে নোটিশ দেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি সিনিয়র সহকারী জজ ধীমান চন্দ্র মন্ডল।
ময়মনসিংহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্তর পক্ষে দল বেঁধে প্রচার চালিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সুধীর চন্দ্র পাল। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলোর ছবি পোস্ট করছেন।
চট্টগ্রাম-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করছেন স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরী। এ চিকিৎসকের নির্বাচনি প্রচারে অনেক সরকারি ডাক্তার নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
চিকিৎসা অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, শুধু সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক নন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। যারা নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছেন, তারা আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন। কিন্তু সরকারি চিকিৎসকদের এমন তৎপরতার বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব বেশি নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারি চিকিৎসকরা নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে যাচ্ছেন-আমার কাছে এমন তথ্য নেই। কেউ জানাননি। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলব। তিনি বলেন, সরকারি চাকরি আচরণবিধিতে এটি নিয়ে বিধিনিষেধ আছে। তবে চিকিৎসকরা কোন অবস্থানে থেকে কেন প্রচারে গেছেন খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, স্বাচিপ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। ফলে কোনো চিকিৎসক অফিস সময়ের বাইরে প্রচার চালালে আমাদের কিছু করার নেই। চাকরিবিধি অনুযায়ী কাজ ফেলে এমনটা করা যাবে না। আমাদের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। তার তথ্য সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপরও কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অধিদপ্তর থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।