আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছোট-মাঝারি ২৫টি দল ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিলেও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনো ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। ফলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘ভূমিধস’ বিজয় অনেকটা আগেভাগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে দেশের মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে ভোটের আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ৭ লড়াইয়ে জিততে হবে। তা না হলে এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে একক দল হিসেবেও সরকার গঠন করলে তাদের কর্তৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনটাই আশঙ্কা করছেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোটের আগেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আন্তর্জাতিক চাপ সামাল, যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তির দেশগুলোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ভীতি দূরীকরণ, ভোটকেন্দ্রে স্বাভাবিকসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং চোরাগোপ্তা হামলা বন্ধ ও ভোটারের নিরাপত্তার আস্থা তৈরির ইস্যুতে আগাম লড়াই লড়তে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা ব্যর্থ হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তকমা জোগাড় করা দুস্কর হয়ে পড়বে। ভোটের আগে নতুন করে আরও কিছু সংকট তৈরি হতে পারে যা মোকাবিলা করারও প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের থাকতে হবে বলে মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ-এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এমনকি সেই নির্বাচন পর্যন্ত দেশকে নেওয়ার মধ্যেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে। তারা কীভাবে সেটি সামাল দিতে চায় সেটিও দেখার বিষয়- যোগ করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনের জন্য সহিংসতামুক্ত নিরাপদ ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে নির্ভয়ে ভোট দেওয়া সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো আওয়ামী লীগের জন্য ‘সর্বোচ্চ মাত্রার একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার’ হবে। তার ধারণা, এটা পুরোপুরি সুরাহা হবে না। কারণ এখন একটা ধারণা জন্মে গেছে, দলীয় নমিনেশন পাওয়া মানে জয় নিশ্চিত। আর এরকম চিন্তা যখন বিকশিত হয় তখন প্রত্যেকে মরিয়া হয়ে ওঠে।
রাজনীতির এই বিশ্লেষক মনে করেন, সর্বোচ্চ পর্যায়কে অগ্রাহ্য করার সাহস হয়তো কারো হবে না অর্থাৎ যিনি নমিনেশন পাবেন তার বিরুদ্ধে হয়তো কেউ প্রকাশ্যে লড়াই ঘোষণা করবে না। তবে উৎসাহের সঙ্গে লোকজনকে মাঠে নামানো খুব কঠিন হবে।
যদিও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের দাবি, স্থানীয় রাজনীতির কারণে অনেক সময় দলীয় বিভক্তি তৈরি হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময় তা থাকবে না। দল যাকে মনোনয়ন দেবে দলের নেতাকর্মী সবাই তার পক্ষে উৎসাহের সঙ্গে কাজ করবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, যখন কাউন্সিল হয়েছে সেখানে অনেকেই বিভিন্ন পদের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু সবাই পদ পাননি। ফলে তাদের মধ্যে একটা বিভক্তি তৈরি হয়েছে। আবার স্থানীয় নির্বাচনের সময় অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়েছেন তাদের কেউ কেউ বিজয়ী হয়েছেন। তাদেরও নিজস্ব একটা বলয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু যখন জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্ন আসবে তখন দলকে বিজয়ী করতে সবাই একযোগে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই নিদের্শই দিয়েছেন যা সব নেতাকর্মী মানবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন, চলমান রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো যেমন কঠিন তেমনি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে টানার আস্থা তৈরি করাও আওয়ামী লীগের জন্য এখন অনেক বড় লড়াই। কেননা বিএনপিবিহীন নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্র বিমুখ করে তুলবে। বিশেষ করে তাদের নেতাকর্মী-সমর্থক ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার বিষয়টি আগেভাগেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোটাররাও অনেকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কষ্ট করে ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারাবে। অথচ ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠবে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগেভাগেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে। তাই ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট করতে এবার নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার ছক তৈরি করছে। যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তা স্বীকার করলেও তাদের সে কৌশলের বিষয়টি পরিষ্কার করেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ এবার ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারবে’। তারা দলীয় টিকিট দেওয়া প্রার্থীর বাইরে দলের অন্য কোনো নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলে তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকবে। এ ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা থেকে আওয়ামী লীগ বিরত থাকারও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, এবার বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে একটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হিসেবে হাজির করতে পারে। প্রথমত, বিএনপিতে একটা ভাঙন হতে পারে যারা নির্বাচনমুখী তাদের নির্বাচনে আনার একটা চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগেও বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াতে পারে। তাদের হয়তো মাঠ ছেড়ে দেওয়া হবে। এতে নির্বাচন কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেওয়ার লড়াইও আওয়ামী লীগকে দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনের আগেই সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছে। তা উপেক্ষা করে তফসিল ঘোষণার পর শ্রমনীতি ঘোষণা করে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন হয়ে গেলেও নির্বাচনের পরে অনেক পদক্ষেপের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। বিষয়টি গার্মেন্টস শিল্পমালিকসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাই তাদের সে ভীতি দূর করতে না পারলে শেষ মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের কয়েক কোটি শ্রমিক ভোট বিমুখ হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক চাপ সামলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হলে আমদানি-রপ্তানির যে নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়বে তা বিবেচনায় রেখে তাদেরও একটি বড় অংশ এ নির্বাচনের প্রতিবাদে আন্দোলনরত বিএনপির পক্ষে সমর্থন দিতে পারে বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই।
অন্যদিকে ভোটের আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জকেও বড় করে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি অঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ বিষয়টি তাদের জন্য একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসেবেই আট শতাংশের উপরে। যা এখন খাদ্যপণ্যে ১২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও বাস্তবিক অর্থে বাজারের চিত্র দেখলে সেটা আরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে না পারলে তার জন্য রাজনৈতিক মূল্য দেওয়া লাগতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কেউই বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে চাননি। উল্টো তারা মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা সংকটকে দায়ী করে দায় এড়াতে চেয়েছেন। তবে অর্থনীতিবিদরা এজন্য সংঘবদ্ধ বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন।
ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেও আওয়ামী লীগকে ভোটের আগেই বড় লড়াই চালাতে হবে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা। তারা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জনের ঘোষণায় অনড় থেকে তা প্রতিহতে আন্দোলন অব্যাহত রাখলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো এবারও ভোটকেন্দ্রে হামলা ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধাসহ নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। যা র্যাব-পুলিশ কিংবা বিজিবি দিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশ ভোটকেন্দ্র বিমুখ করে তুলতে পারে।
তাই ভোটের আগেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে হবে। যা নির্বাচনী উৎসবের মধ্যে চালিয়ে যাওয়া অনেকটাই কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে চলমান আন্দোলনে সারা দেশে যেসব চোরাগোপ্তা হামলা চলছে ভোটের আগেই তা রুখে দিতে আওয়ামী লীগকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ক্ষমতাসীনদের ভোট উৎসবের মধ্যেই বিরোধী পক্ষের আন্দোলনে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা চলমান থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এ সুযোগের ফায়দা লুটতে পারে। এতে ভোটের প্রচার-প্রচারণার মাঠে গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। যা সাধারণ ভোটের পাশাপাশি ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণার কাজে থাকা নেতাকর্মীদেরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারে।