দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আগামী বৃহস্পতিবার। এর মাঝের সময়কে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বিএনপি। দল ভাঙাগড়ার পাশাপাশি চলছে নতুন জোটেরও আত্মপ্রকাশ। এ নিয়ে নানা তৎপরতা সতর্কের সঙ্গে দেখছে দলটি। গত ২ সপ্তাহ আগে ধারাবাহিক ভার্চুয়াল সভায় অন্য দলে ভেড়াতে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বিভিন্ন ধরনের চাপের কথা জানিয়েছেন হাইকমান্ডকে। পরে চাপ এড়াতে কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দেন। এমনকি ব্যক্তিগত ফোনও নিজের কাছে রাখছেন না নেতারা। এমন কৌশলের কারণে চলমান আন্দোলনে তারা মাঠে নেই। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর রাজপথে নামার নির্দেশনা রয়েছে। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক এ তথ্য জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন সিনিয়র নেতা জানান, এখন দুটি নতুন দলকে কেন্দ্র করে নানা তৎপরতা চলছে। এই দল দুটোতে যোগ দিতে বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের টার্গেট করা হয়েছে। তবে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো নেতাকেই ভেড়াতে পারেনি। ওয়ান-ইলেভেনেও বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। এখন বিএনপি নেতাকর্মীরা আরও ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন।
ওই নেতা আরও জানান, বিএনপিসহ রাজনীতিতে ও ভোটের হিসাবে যেসব দল ফ্যাক্টর তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাদের মধ্যে বাম দলগুলোর বেশিরভাগ ও বড় ইসলামি দলগুলো রয়েছে। নানা ভয়ভীতি ও প্রলোভনে পড়ে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল হয়তো নির্বাচনে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগ দলেরই তেমন নেতাকর্মী নেই। আন্দোলন সফলে দরকার সাংগঠনিক শক্তি। যেসব দল নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের মাঠে সেই শক্তি রয়েছে। সুতরাং এ নিয়ে তারা চিন্তিত নন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘সরকার বিরোধী দলের ওপর অমানবিকভাবে দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। গ্রেফতার ও হামলা করছে, সাজা দিচ্ছে। তারপরও নেতাকর্মীরা মনোবল হারায়নি। আত্মগোপনের মধ্যেও কাজ করছেন তারা। প্রথম থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিচ্ছেন। যে যেখানে, যেভাবে পারে কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার বার্তাও দিয়েছেন। দলেরও নিজস্ব কিছু কৌশল রয়েছে। সুতরাং আন্দোলন চালিয়ে নিতে শীর্ষ নেতাদের কেউ আত্মগোপনে যাওয়া খারাপ কিছু নয়।’
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপি ও সমমনা দলগুলো থেকে লোক ভাগানোর জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে নতুন দলের অদ্ভুত নাম, সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন। নমিনেশন ও টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা একটা নির্লজ্জ, ঘৃণ্য ও জঘন্য কাজ। ক্ষমতাসীনরা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জিতবেন না। এজন্য নির্বাচনকে সামনে রেখে যত ধরনের গণবিরোধী কাজ আছে তারা সব করছেন। একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জনগণকে দমন করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রের টাকা লোপট করে দলছুটদের নিয়ে দল বানানোর কারসাজি চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা গণবিরোধী সরকার যে প্রহসনের নির্বাচন করে, সেই একই কায়দায় আওয়ামী লীগ অনুসরণ করছেন। যেমনটা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে করেছে, এখনো সেটা করছে। জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল কখনো অন্যদলের নেতাকর্মীকে ভাগিয়ে নেয় না। দলের মধ্যে নানা সময়ে সুবিধাবাদী, উৎসৃষ্টভোগীরা ঢুকে পড়ে। আর এই লোকগুলোকেই তারা পায়। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র কখনো সফল হবে না। গণআন্দোলনে সব ষড়যন্ত্র ভেসে যাবে। জনগণের বিজয় হবেই।’
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তফশিলের পরও সারা দেশে এখনো গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। বাড়ি বাড়ি চলছে তল্লাশি। বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখন বাসায় থাকছেন না। তাদের গ্রেফতার এড়িয়ে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নেতারা আরও জানান, চলমান আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে না দেখার কারণ মূলত ‘চাপ’ এড়াতে তারা হাইকমান্ডের নির্দেশে আত্মগোপনে আছেন।
মনোনয়নপত্র জমা শেষ হলে আন্দোলনের একটি পর্ব শেষ হবে। এরপর আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের আরেকটি পর্ব শুরু হবে। তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে দেখা যাবে।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকে ভোটের দিনের মধ্যকার সময়ে বিক্ষোভ, পদযাত্রা ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির মধ্যে থাকা নিয়েও আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি বুঝে ফাঁকে ফাঁকে হরতালও দেওয়া হতে পারে। তবে কোনো কারণে পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে এলে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির মধ্যেই থাকবে এমন আলোচনাও আছে।
স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে নেতারা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পূর্বাপর পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। নেতাদের ধারণা, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং অন্য ছোট দলগুলোকে ছেড়ে দেওয়া আসনে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হবে। ওই পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির চেয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণে পর্যবেক্ষণ রেখে পরবর্তী কৌশল ঠিক করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
এদিকে সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতারাও কেউ আত্মগোপনে, আবার কেউ নীরব আছেন। সমমনা জোটে থাকা শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোটের আরও কয়েকটি দলও চাপের মধ্যে রয়েছে। তাদেরও নির্বাচনে নেওয়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। তবে বিএনপি থেকে সাহস ও শক্তি পাচ্ছেন তারা।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, পাঁচ-ছয় জায়গা থেকে আহ্বান এসেছিল নির্বাচনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না এলডিপি। ভাগাভাগির কোনো নির্বাচনে যাবে না। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলে সেই নির্বাচনে যাবে। বেইমানি করবে না। মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য এলডিপি রাজনীতি করে না, দেশের জন্য রাজনীতি করে। মানুষের জন্য কাজ করতে চায়। বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে সঙ্গে থাকবে এলডিপি।
গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, তাদের ওপরও চাপ রয়েছে। কিন্তু যত চাপই থাকুক না কেন, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক শাসকগোষ্ঠী তা চায় না। তারা বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে নানা ছক কষছে। সেই আলোকে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে গণবিরোধী নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা করেছে। মূলত আওয়ামী লীগকে বিনা ভোটে আবারো ক্ষমতায় বাসানোর জন্যই এই তফশিল। সরকার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য কেনাবেচার মাধ্যমে কিছু লোককে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণ ইতোমধ্যেই এই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে বিশ্বাসঘাতক ও বেইমানির রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেছে।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের নেতারাও জানান, নানা প্রস্তাব তারা পাচ্ছেন। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা যাবেন না। শুক্রবার সকালে বাৎসরিক মাহফিলে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হলে নির্বাচনের নামে পাতানো ফাঁদে পা দেব না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম (রহ.) কখনো অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেননি। যত বড় বাধার পাহাড় নেমে আসুক না কেন, সত্যের পথ থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। আমরাও অন্যায়ের সঙ্গে কখনোই আপস করব না।