
anusandhan24.com :
আসন্ন ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পর পর দুইবার দুঃসংবাদ পেল মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি বলছে, খারাপ সময় শুরু হলো তৃণমূলের। সোমবার জাতীয় দলের মর্যাদা হারিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। পরদিন মঙ্গলবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াল তৃণমূলের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য ও গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফ্যালেইরো। এদিন রাজ্যসভার উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের হাতে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। এরই মধ্যে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন উপরাষ্ট্রপতি।
অন্যদিকে জাতীয় দলের তকমা হারানোয় বিশেষজ্ঞরা বলছে, জাতীয় পর্যায় রাজনৈতিক গুরুত্ব হারাবে তৃণমূল কংগ্রেস।
২০২৪ সালে মোদিবিরোধী মুখ হিসেবে মমতাকে সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। আপাতত সেই প্রচেষ্টাতেও ইতি টানতে হচ্ছে দলটিকে। কারণ জাতীয় দলের স্বীকৃতি হারিয়ে একাধিক ‘লোকসানের’ মুখে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেসে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূলের এই ‘ধাক্কা’ বঙ্গ রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
জাতীয় দলের তকমা হারানোয় কী কী সমস্যায় পড়তে হতে পারে তৃণমূল?
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, কোনো দল জাতীয় দলের তকমা পেলে, সংশ্লিষ্ট দলটির জন্য একটি প্রতীক রিজার্ভ বা নির্দিষ্ট করা থাকে। সেক্ষেত্রে তৃণমূল যদি জাতীয় দল থাকত, তাহলে জোড়াফুল প্রতীকও রিজার্ভ থাকত। কিন্তু এখন আর তা থাকল না। যদিও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মণিপুরে দলের নাম ও প্রতীকে ভোট ময়দানে নামতে পারবে তারা। কিন্তু জাতীয় স্তরে দেখতে গেলে, জোড়াফুল প্রতীক আর তৃণমূলের জন্য রিজার্ভ থাকছে না। অর্থাৎ আপাতত তিন রাজ্যের বাইরে নির্বাচনী লড়াইয়ে দলের জোড়াফুল প্রতীক হারাতে পারে তৃণমূল।
এখন থেকে শুধু আঞ্চলিক দল হিসেবেই ধরা হবে বাংলার শাসকদলকে। আর এর জেরে পশ্চিমবঙ্গেও ইভিএম অথবা ব্যালট পেপারে জাতীয় দলের তালিকায় প্রথম দিকে দেখা যাবে না তৃণমূলের প্রতীকী চিহ্ন। দলের নামের আগে আর ‘সর্বভারতীয়’ শব্দটিও ব্যবহার করতে পারবে না জোড়াফুল শিবির। ফলে দলের ইমেজে বড় ধাক্কা আসতে পারে। দিল্লিতে আর দলের দপ্তর রাখা যাবে না। দলীয় দপ্তর তৈরির জন্য রাজধানী শহরে তৃণমূলকে আর জমি কিংবা বাড়ি দেওয়া হবে না।
জাতীয় নির্বাচন কমিশন সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলে এবার থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ডাক নাও পেতে পারে। জাতীয় দল হওয়ার কারণে এতদিন নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে আমন্ত্রণ পেত তৃণমূল কংগ্রেস। তবে জাতীয় দলের স্বীকৃতি চলে যাওয়ায় আর জাতীয় দলগুলোর বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না তৃণমূল কংগ্রেসকে। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত নিজেদের মতামত জানাতে এবার থেকে আরও বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে জোড়াফুল শিবিরকে।
এদিকে, জাতীয় দলের মর্যাদা হারানোয় এবার থেকে তারকা প্রচারকের সংখ্যা ৪০ থেকে কমিয়ে ২০-তে রাখতে হবে তৃণমূলকে। ভোট প্রচারের জন্য সরকারি টিভি ও রেডিওতে বিনামূল্যে বিজ্ঞাপনের সুবিধা আর মিলবে না। জাতীয় দলের স্বীকৃতি পেলে সেই দলটি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারি পরিচালিত টেলিভিশন বা রেডিওতে সম্প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট সময় পেতে পারে। কিন্তু জাতীয় দলের তকমা হারানোর ফলে, সেই সুবিধা তৃণমূলের আর থাকছে না।
জাতীয় দল না হওয়ায় ভোটার লিস্টের দুইটি কপি আর নির্বাচনের কমিশনের তরফে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না। এছাড়া পলিটিক্যাল ফান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও খানিক সমস্যা ভোগ করতে হতে পারে। জাতীয় দলের স্বীকৃতি হারানোয় আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রেও বড়সড় ধরনের ফারাক লক্ষ্য করা যেতে পারে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী জোটের ‘মুখ’ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন মমতা ব্যানার্জি। এই আবহে যদি লোকসভা ভোটের আগে অর্থের জোগান কমে যায়, তাহলে আগামী বছর নির্বাচনী প্রচারে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে বাংলার দলকে। যদি কোনো জাতীয় দলের তকমা পায়, তাহলে নির্বাচন দিনক্ষণ স্থির করার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট দলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা থাকে। যেমন নির্বাচনী বিধি তৈরিই হোক বা ভোটের দিনক্ষণ স্থির করার ক্ষেত্রেই হোক, জাতীয় দলগুলো একটি নিজেদের মতামত দিতে পারে। জাতীয় দল হওয়ার সুবাদে তৃণমূলের হাতেও এতদিন সেই সুবিধা ছিল। কিন্তু সোমবার ‘অঘটনের’ পর সেই সুযোগ হাতছাড়া হলো তৃণমূলের।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা জানায়নি মমতার দল। দিনভর মমতা ব্যানার্জি তরফ থেকেও আসেনি কোনো বিবৃতি।
তবে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সংসদ সদস্য সৌগত রায় বলেন, নির্বাচনের কমিশনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা সহমত নই। এর আগেও নির্বাচন কমিশনের অনেক সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়েছে। আইনি পথে আমরা জবাব দেব।
অন্যদিকে দলের খারাপ সময় আসতেই লুইজিনহো ফ্যালেইরোর পদত্যাগ করা ঘটনায় মঙ্গলবার বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতন তাপস রায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিধানসভার বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লুইজিনহো ফ্যালেইরো সুখের পায়রা, এসব ব্যক্তি মমতা ব্যানার্জির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দল এরকম ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছে।
এদিকে তৃণমূলের এমন অঘটনের দিনে আনন্দে ছিলেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা। মুরলীধর সেনের বিজেপি রাজ্য সদর দপ্তরে রীতিমতো মিষ্টিমুখ করানো হয় দলীয় কর্মীদের। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর গড় পূর্ব মেদিনীপুরেও বাজি ফাটিয়ে মিষ্টিমুখ করেন বিজেপির স্থানীয় কর্মীরা। দিনভর ছিল উৎসবের আমেজ।
মঙ্গলবার বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি ও সংসদ সদস্য দিলীপ ঘোষ বলেন, তৃণমূলের সর্বভারতীয় তকমা চলে গেল, এর থেকেও বড় কথা পশ্চিমবঙ্গে তারা এখন অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে। সর্বভারতীয় পার্টি হওয়ার স্বপ্ন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন, দিল্লি জেতার স্বপ্ন, দিদিকে আপাতত মুলতবি রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আইনি পথে সবাই যেতে পারেন। আমি তো বলি নির্বাচন কমিশনের সামনে ধরনা শুরু করে দিন। ইট-পাথর মারুন, যেটা তৃণমূল কংগ্রেসের কালচার। আদালতে গিয়ে কী হবে? নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তেই আদালত সম্মতি জানাবে। এখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তাই হয়েছে। সংবিধান, নিয়ম-কানুন এরা কিছুই মানেন না এই পার্টিটাকেই সম্পূর্ণভাবে ব্যান করা উচিত।
তৃণমূলকে কটাক্ষ করে টুইট করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। তিন লেখেন, ‘নামের পাশ থেকে কবে অল ইন্ডিয়া-টা সরবে?’
অন্যদিকে, ৭০ বছর পর শরীক দল সিপিআইয়ের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) জাতীয় দলের মর্যাদা বাতিল হলেও তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি সিপিআইএম নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, তৃণমূল আবার জাতীয় দল কবে, ওটা তো আঞ্চলিক দল। মোটেও তারা সর্বভারতীয় দল নয়। তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিপুরাতে গিয়েছে বটে। ওখানে একটু বিজেপিকে সাহায্য করেছে। মেঘালয়েও বিজেপিকে সাহায্য করেছে। বিজেপিকে সাহায্য করা তো একটা দলের সর্বভারতীয় হওয়ার ভিত্তি হতে পারে না। জাতীয় দলের মতো কোনো বিষয় তৃণমূলের মধ্যে নেই। অন্য রাজ্যে ভালো ফল করলে নয়, কথা হতে পারত।
তৃণমূল ছাড়াও সিপিআই ও শরদ পাওয়ারের এনসিপিও জাতীয় দলের তকমা হারিয়েছে। যদিও বর্তমানে ভারতে জাতীয় দল হিসেবে থাকছে আরও ছয়টি দল। সেগুলো হলো- কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, বিএসপি, এনপিপি ও সাম্প্রতিক সংযোজন আম আদমি পার্টি।