বুধবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২রা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিরাপত্তাহীন পারমাণবিক কেন্দ্রে ফুয়েল লোড বিপজ্জনক

প্রকাশিত : ০৮:৪২ পূর্বাহ্ণ, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বুধবার ৮ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনের দ্বারপ্রান্তে। আগামী ৬ নভেম্বর রিঅ্যাক্টরে পারমাণবিক জ্বালানি (ফুয়েল) লোড করার প্রাথমিক তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদনে যাওয়ার আগে স্পর্শকাতর এ স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলেই জানাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো। অথচ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একেবারে উল্টো চিত্র। সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পর রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ৮৫ পাতার একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএইএ। ওই প্রতিবেদনে রূপপুরে নিরাপত্তার যেসব ঘাটতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা শিউরে ওঠার মতো। সংস্থাটির দাবি, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অপূর্ণতা, জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ভঙ্গুর বন্দোবস্ত, বিকিরণ নিয়ন্ত্রণের আয়োজনে ফাঁকফোকর, প্রশিক্ষণে ঘাটতি এবং ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ না করে পূর্বনির্ধারিত তারিখে (৬ নভেম্বর) ফুয়েল লোডিং শুরু হলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইএইএ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএইএর সতর্কতা আমলে না নিয়ে তড়িঘড়ি কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নন, পুরো রূপপুরের বাসিন্দাদের চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আইএইএর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত ১০-২৭ আগস্ট রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে মিশন পরিচালনা করে। এরপর সংস্থাটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রেস নোট প্রকাশ করে। যেখানে ‘কমিটমেন্ট, ইমপ্রুভমেন্ট, ইনহ্যান্সমেন্ট’ জাতীয় শব্দগুলো বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। রূপপুর কর্তৃপক্ষ এই নোটটিকে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণপত্র হিসেবে প্রচার করছে। অথচ ওই নোটে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে—নিরাপত্তার মানদণ্ডে ঘাটতি রয়েছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আইএইএর ৮৫ পাতার গোপন প্রতিবেদনটি সম্প্রতি হাতে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আইএইএ মিশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যথেষ্ট অনিরাপদ এবং ভয়াবহ। ওই প্রতিবেদনের তথ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে নিজস্ব অনুসন্ধানেও জানা গেছে রূপপুরের কার্যক্রমের নানা জোড়াতালি ও অসংগতির চিত্র।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসারে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং কার্যক্রমের শুরুতেই ‘নন-নিউক্লিয়ার টেস্ট’ (non newcleare test) সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। এর মধ্য দিয়ে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (জ্বালানি) ব্যবহার না করেই কেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কার্যপ্রণালি যাচাই করা হয়। কিন্তু রূপপুর প্রকল্পে এসব পরীক্ষা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করতে হবে Primary Circuit, Containment, Biological Shielding, Fuel Pellet ও Fuel Rod Cladding। এ ছাড়া সাপোর্ট সিস্টেম যেমন Compressed Air, Nitrogen-Oxygen Generation, Water Collection ও Purification, Standby Power এবং Water Intake System-এর কমিশনিংও বাধ্যতামূলক। HVAC সিস্টেমের কার্যকারিতা, যন্ত্রপাতির অবস্থান ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও পরীক্ষা করে চালু রাখতে হয়। যার অর্থ, রূপপুরে এখনো বহু সাপোর্ট সিস্টেম ইনস্টল ও পরীক্ষা হয়নি। Instrumentation and Control System, Acoustic Leak Detection, Humidity Leak Monitoring, Loose Part Detection, In-Core Monitoring, Neutron Flux Monitoring, Engineering Safety Feature Actuation, Radiation Monitoring, Fire Detection ও Protection System-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমের ইনস্টলেশন অসম্পূর্ণ। এ ছাড়া হাজার হাজার সেন্সর, ভেন্টিলেশন সিস্টেম, কন্ট্রোল ভলভ, পাম্প ও কম্প্রেসর, ওয়াটার ইন্টেক চ্যানেল, ফ্লো কন্ট্রোল উপাদান এবং পাওয়ার সাপ্লাই এখনো ঠিকঠাক ইনস্টল হয়নি।

IAEA-এর স্টেজ বা সাব-স্টেজ প্রোগ্রাম অনুযায়ী, A0 থেকে D ধাপ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা চালানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। A0 সাব-স্টেজে ৩৯ মাসে ৫৫৯টি SAW (Startup and Adjustment Work) সম্পন্ন হওয়ার কথা, বাস্তবে শেষ হয়েছে মাত্র ১৬টি। A1 সাব-স্টেজের ১১৮৭টি কাজের মধ্যে মাত্র ৯৯টি সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময় ৯ মাস, প্রকৃত সময় লেগেছে ২৪ মাস। A3 এবং A4 সাব-স্টেজে কার্যক্রম এখনো স্থবির। ফিজিক্যাল স্টার্টআপের আগে মোট ১৭৪৬টি SAW-এর মধ্যে ১৭১টি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই ধাক্কাধাক্কি এবং কার্যক্রমের বিলম্ব পুরো কমিশনিং প্রক্রিয়াকে সংকটাপন্ন করছে।

ফুয়েল লোডিং: সবচেয়ে বড় ঝুঁকি

আইএইএর ৬১ নম্বর পাতার ১২.৪ সেকশনে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামগ্রিক প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমাপ্তি, পাশাপাশি প্রাথমিক জ্বালানি লোডের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র যথেষ্ট দৃঢ় বা সমাপ্ত নয়, যা সময়মতো ও ধারাবাহিকভাবে পূর্বশর্তগুলো পূরণ, পরিবর্তনের সঠিক শনাক্তকরণ এবং সময়মতো অনুমোদন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।’

৭০ নম্বর পাতায় ১২.৪(১) অনুচ্ছেদে একই বিষয় ফের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক জ্বালানি লোডিংয়ের জন্য টেস্ট প্রোগ্রাম, সিস্টেম এবং ডকুমেন্টেশনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে প্লান্টের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাটি পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়, যার ফলে জ্বালানি লোড শুরুর আগে পূর্বশর্তগুলো সন্তোষজনকভাবে পূরণ হবে বলে নিশ্চিত হওয়া যায় না।’

৭০-৭১ নম্বর পাতায় এই অনুচ্ছেদের ১৪টি উপ-অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে অব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক যন্ত্রপাতি এখনো বসানো হয়নি, প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়নি এবং সেগুলো কখন বসানো হবে, তা নির্ধারিত শিডিউলও কার্যত গ্রহণযোগ্য নয়। স্টেজ প্রোগ্রামগুলো শুধু কাটছাঁট করা হচ্ছে, আর ৩ হাজার টেকনিক্যাল সমাধান দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াগুলো কোনোভাবেই নির্দেশ করে না কোন সিস্টেম কখন অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হবে।

উপরোক্ত ১৩-১৪টি উপ-অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করে সংস্থা জানিয়েছে, ‘কমিশনিং শিডিউল, কার্যক্রমের সমাপনীর সময়সীমা এবং করণীয় বিষয়গুলোর পর্যাপ্ত দৃশ্যমানতা না থাকার কারণে নিরাপত্তা-সম্পর্কিত পূর্বশর্তের অনুমোদন ও মুক্তিকরণের সময় ত্রুটি ঘটার ঝুঁকি রয়েছে।’

এই অনুচ্ছেদের শেষে আইএইএ সুপারিশ করেছে, ‘পারমাণবিক জ্বালানি লোডিং শুরুর আগে সব প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত সম্পন্ন হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পরীক্ষা কর্মসূচি, সিস্টেম এবং ডকুমেন্টেশনের প্রস্তুতি শক্তিশালী করার বিষয়টি প্লান্টের বিবেচনায় আনা উচিত।’

জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থায় ভঙ্গুরতা:

আইএইএ-এর ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠার নবম অধ্যায় অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জরুরি পরিকল্পনা ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। সংস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকায় থাকা প্রধান জরুরি সুবিধাগুলো এখনো নির্মাণাধীন এবং যে কোনো দুর্ঘটনা বা জরুরি পরিস্থিতিতে কার্যকর প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজেল জেনারেটর, ফিল্টারযুক্ত ভেন্টিলেশন সিস্টেম, পানি সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো স্থাপনাধীন। প্ল্যান্ট বা জরুরি কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও যথাযথভাবে বিতরণ করা হয়নি। উপরন্তু, প্ল্যান্টের অন-কল ডিউটি সংস্থা সবসময় পুরোপুরি প্রস্তুত জরুরি প্রতিক্রিয়া দল (Emergency Response Force) নিশ্চিত করতে অক্ষম। আইএইএ ৫৪-৫৬ পাতায় পর্যালোচনা শেষে স্পষ্ট জানিয়েছে, ‘যথাযথভাবে বাস্তবায়িত জরুরি প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জনসাধারণ এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না।’

প্রতিবেদনের ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠার দশম অধ্যায় অনুযায়ী, দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভয়ংকর অব্যবস্থা বিরাজ করছে। যদিও আংশিকভাবে টেবিল-টপ অনুশীলন ও সাইট-ড্রিলের মাধ্যমে জরুরি ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা করা হয়েছে, প্ল্যান্ট কর্মীরা কোনো পূর্ণাঙ্গ ড্রিল চালাননি। ফলে শিফট হস্তান্তর, দলগুলোর মধ্যে তথ্য হস্তান্তর এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা জেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যকারিতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আইএইএ সতর্ক করেছে, এই অব্যবস্থা যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তাকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

বিকিরণ সুরক্ষার ফাঁকফোকর:

আইএইএর প্রতিবেদনের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার ৭ নম্বর অধ্যায় অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা গুরুতর ঘাটতি বহন করছে। সংস্থা সতর্ক করেছে, রেডিওলজিক্যাল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কর্মস্থল পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি অর্ধেক রকমই কার্যকর, এবং নতুন জ্বালানি ভবনের জন্য প্রণীত পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে কর্মীদের বিকিরণ সুরক্ষা এবং স্থাপনার নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির মুখে। প্রতিবেদনের ৭ দশমিক ৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রেডিওলজিক্যাল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশের ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট সুবিধাগুলো কার্যকরভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে অক্ষম।

অষ্টম অধ্যায়ে সংস্থা রসায়ন ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও উল্লেখ করেছে। বাস্তবসম্মত (real-time) রাসায়নিক তথ্য বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথভাবে ভাগ করা হয় না, যা পর্যবেক্ষণে অসঙ্গতি তৈরি করতে পারে এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ডোজ নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া, প্ল্যান্টের রাসায়নিক পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে অকমিশনকৃত ল্যাবরেটরি এবং অসম্পূর্ণ স্যাম্পলিং ব্যবস্থা, অন-দ্য-জব প্রশিক্ষণের অভাব, এবং মানসম্মত কোয়ালিটি কন্ট্রোল চার্ট ও ডেটা শিটের অভাব ত্রুটি শনাক্তকরণ ও দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

সংস্থাটি আরও সতর্ক করেছে যে, কমিশনকৃত ল্যাবরেটরি ও স্যাম্পলিং ব্যবস্থা না থাকায় এবং ম্যানুয়াল, মানসম্মত নয় এমন কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরতার কারণে অজানা ত্রুটি শনাক্তকরণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, যা প্ল্যান্টের নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ৮.৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণ সহায়ক রাসায়নিক পদার্থের যথাযথ শনাক্তকরণ, লেবেলিং ও ব্যবস্থাপনা না থাকলে রাসায়নিক স্পিলেজ, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া এবং অযথাযথ পরিচালনার ঝুঁকি বাড়ে, যা কর্মীদের জন্য অগ্নি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এই বিষয়গুলোর ওপর সংস্থা দুটি সুপারিশ প্রদান করেছে।

ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা:

আইএইএ রিপোর্টের প্রথম অধ্যায়জুড়েই ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতার বিস্তারিত বিবরণ। বলা হয়েছে—রূপপুরে কোনো সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা (Integrated Management System) নেই। ঝুঁকি মূল্যায়ন হয় না, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে কোনো তদারকি নেই। নিরাপত্তা কমিটিগুলো কার্যকর নয়, দায়িত্ব অস্পষ্ট।

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয়নি, নিরাপত্তা কর্মক্ষমতার ওপর কোনো নজরদারি নেই। এমনকি ম্যানেজারদের কেউ কেউ প্ল্যান্টে কতজন আহত হয়েছে তার সঠিক তথ্যও জানে না। আইএইএ সাফ জানিয়েছে—‘একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা কাঠামো ছাড়া এই প্ল্যান্ট নিরাপদভাবে চালানো সম্ভব নয়।’

প্রতিবেদনের ২.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের কোনো সুস্পষ্ট মানদণ্ড নেই। কর্মীরা তাত্ত্বিক ক্লাস পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা বাস্তব দক্ষতায় রূপান্তরিত হচ্ছে না। রিঅ্যাক্টিভিটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ব্রিফিং হয় না, মক-আপ বা সিমুলেটর প্রশিক্ষণ মানসম্মত নয়। আইএইএর মতে, এ অবস্থায় কর্মীরা সংকটময় পরিস্থিতি সামলাতে সক্ষম হবে না।

অপারেশনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রোটোকল কার্যকর হয়নি। ম্যানেজারদের মধ্যে তদারকি দুর্বল, ফলে যন্ত্রপাতি চালনা ও নিয়ন্ত্রণে খামখেয়ালি ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগও এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি তৈরি করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় রক্ষণাবেক্ষণ সিস্টেম নেই, অনুমোদিত নির্দেশনা নেই, খুচরা যন্ত্রাংশের তালিকা নেই। সবকিছু বহিরাগত ঠিকাদারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ পুরোপুরি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-টেকনিক্যাল সাপোর্ট বিভাগ নিরাপত্তা-সম্পর্কিত যন্ত্রপাতির নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। কোনো কার্যকর মনিটরিং সিস্টেম নেই।

অপারেটিং এক্সপেরিয়েন্স ফিডব্যাকেও বড় ফাঁক রয়ে গেছে। সমস্যা দেখা দিলে তার মূল কারণ খুঁজে সমাধান না করে কেবল সাময়িক সমাধান করা হয়েছে। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

আইএইএর এই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের প্রতিটি অধ্যায়ে অসংগতি, দুর্বলতা ও ঝুঁকির কথা লেখা থাকলেও সরকার সেটিকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করছে একেবারে উল্টোভাবে। বলা হচ্ছে সব পরীক্ষা শেষ, কেন্দ্র শতভাগ নিরাপদ, এখন কেবল জ্বালানি লোড করলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। অথচ আন্তর্জাতিক সংস্থাটির ভাষায় ‘যদি পূর্বশর্তগুলো পূর্ণ না হয়, তবে রূপপুরে গুরুতর দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হবে।’

আইএইএর ৮৫ পাতার রিপোর্টের প্রতিটি অধ্যায়েই অসংগতি, দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে। সুপারিশ ও পরামর্শ মিলিয়ে অন্তত ডজনখানেক জায়গায় বলা হয়েছে-রূপপুর এখনো নিরাপদ নয়। অথচ সরকার এটিকে ‘সব ঠিকঠাক’ প্রমাণ হিসেবে প্রচার করছে। প্রতিবেদনটির শেষাংশে আইএইএ লিখেছে-

আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সতর্ক করেছে—‘প্রাথমিক জ্বালানি লোডিং শুরুর আগে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তগুলো সম্পন্ন না হলে, গুরুতর দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো যাবে না।’

আইএইএর রিপোর্টের সত্যতা মেলে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নথিপত্রেও। তথ্য বলছে, রূপপুরে Non-Nuclear Test-এর ধাপও অসম্পূর্ণ। Cold Run এবং Hot Run পরীক্ষা, যা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সার্কিট, রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প এবং প্রেশারাইজারের কার্যকারিতা নির্ণয় করে সম্পূর্ণ হয়নি। স্টিম উৎপাদন ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ ডাটা সংগ্রহের কাজও সীমিত। ফলে Nuclear Fuel লোড করার আগে সেফটি সিস্টেম কনফিগারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত অসম্পূর্ণ।

নিরীক্ষকরা সতর্ক করেছেন যে, কমপক্ষে ১৫৭৫টি SAW এবং Post Installation Cleaning, Individual Testing অসম্পূর্ণ থাকায় ফুয়েল লোডের আগে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া কন্ট্রোল সিস্টেমের কনফিগারেশন অসম্পূর্ণ, বহু সেন্সর এবং মেকানিক্যাল উপাদান অনুপস্থিত। নন-স্ট্যান্ডার্ড পাওয়ার কেবল ব্যবহার হচ্ছে, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো জটিল প্রকল্পে বিপজ্জনক। Instrumentation ও Control System ছাড়া মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি কার্যকর নয়।

পরমাণু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভঙ্গুর অবস্থায় রূপপুরকে নির্ভরযোগ্যভাবে চালু করা বা Physical Start-up করা বিপজ্জনক হতে পারে। স্টেজ প্রোগ্রামে নির্ধারিত কাজের অনেকাংশ বাকি রেখে সরাসরি ফুয়েল লোডের চেষ্টা, Radiological পরিস্থিতি জটিল করবে এবং নিউক্লিয়ার অপারেশনে সরাসরি ঝুঁকি তৈরি করবে।

নিরীক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন—কী কারণে ১৫৭৫টি SAW এখনো অসম্পূর্ণ? কাজগুলো অন্য স্টেজে ট্রান্সফার করা, ম্যানুয়ালভাবে কম্পোনেন্ট পরিচালনা করার চেষ্টা এবং অন্যান্য ছদ্ম-তাড়াহুড়ো প্রকল্প কার্যক্রম কি প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারছে? এই অনিয়ম, বিলম্ব ও অসম্পূর্ণ কমিশনিং কার্যক্রম প্রকল্পের সেফটি ব্যবস্থাকে তাৎক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি টেস্টের জন্যে নির্ধারিত সময় ছিল। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না করে তাড়াহুড়ো করে এখন সব টেষ্ট একসঙ্গে করলেও সেটি ঝুঁকিমুক্ত হবে না।

IAEA গাইডলাইনের আলোকে রূপপুরের পরিস্থিতি চিহ্নিত করছে যে, প্রাথমিক পরীক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ফুয়েল লোড করা উচিত নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় ও নিউক্লিয়ার সেফটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হলে অপারেশন শুরু করা প্রকল্পের জন্য ‘টিকিং টাইম বোমা’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো প্রকল্প এখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছানের একচ্ছত্র আধিপত্য। অনেক প্রশিক্ষিত জনবলকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেককে নিজ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুরো প্রকল্পে জাহেদুল হাছানের ঘনিষ্ঠজনদের বসানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভিপ্রায়ে টেস্ট এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই পুরো প্রকল্পকে সফলভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন জাহেদুল।

এসব বিষয়ে নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইএইএর প্রতিনিধিদল পরিদর্শন করে বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা পেয়েছে। তাদের অভিব্যক্তিগুলো খুব কূটনৈতিক ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়। যেটা ভালো, সেটি সরাসরি প্রকাশ করে; আর যেগুলো নিয়ে সমস্যা রয়েছে, সেগুলো তারা সুপারিশ বা রিকমেন্ডেশন আকারে তুলে ধরে।’

তিনি বলেন, ‘আইএইএ নির্দিষ্টভাবে অপারেশনাল সেফটির ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এখনো অনেক টেস্ট বাকি রয়েছে। আইএইএ যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে যে চ্যালেঞ্জগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে, সেগুলো সমাধান না করা পর্যন্ত ফুয়েল লোড করা যাবে না। এ অর্থে আমি বলব—অনেক কিছুই দ্রুত সমাধান ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। এগুলো সমাধান করার পরই ফুয়েল লোডিং হতে পারে। কারণ, ফুয়েল লোড করার অর্থ হলো সবকিছু প্রস্তুত আছে, তারপরই কমিশনিংয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এখনো অনেক অবকাঠামো প্রস্তুত নয়। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এখন পর্যন্ত টেকনিক্যাল সাপোর্ট পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, রেগুলেটরি বডির অনেক নিয়মকানুনও এখনো তৈরি হয়নি। আবার রেডি অপারেটর তৈরি করার জন্য যে লাইসেন্স প্রয়োজন, সেটিও প্রস্তুত নয়। উপরন্তু প্লান্টের বহু ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি আছে। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরই ফুয়েল লোডিং প্রসঙ্গ আসা উচিত।’

সতর্ক করে ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ যদি সেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সরাসরি অপারেশনে যায়, তাহলে কী ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি, তা কল্পনা করাই কঠিন। একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার ফ্যাসিলিটিকে সর্বোচ্চ নিরাপদ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এগুলো না করা হয়, তবে মানবিক ভুলের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এখানে যদি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, অর্থাৎ ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, চরমভাবে শক্তিশালী ও সমন্বিত না হয়, কর্মীবান্ধব পদায়ন ও প্রমোশন না দেওয়া হয়, তবে সেই কালচার বিকৃত হয়ে যাবে। আমি বলব, এ ধরনের ত্রুটি রেখে কখনো নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট চালানো সঠিক হবে না। এতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে।’

বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে মেইল করা হয় আইএইএর সিনিয়র নিউক্লিয়ার সেফটি অফিসার সাইমন মরগ্যানকে। তবে তিনি মেইলের জবাব দেননি। সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. কবীর হোসেনের সঙ্গে। তবে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বলেন, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছ; কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি। চাইলেই ফুয়েল লোড করা সম্ভব নয়। আমরা যখন এটা কমপ্লিট করব, টেস্ট যখন কমপ্লিট করব, টেস্ট কমপ্লিট করার পর আমরা রেগুলেটরি অথরিটির কাছে সাবমিট করব, তারপর ফুয়েল লোড সিদ্ধান্ত দেবে অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন ও বিএসসি। তারা হচ্ছে অথরিটি। এক্সপার্ট অর্গানাইজেশন আছে অর্থাৎ এই অর্গানাইজেশনগুলোকে যখন সম্মতি দেব তখন লোডিং করতে পারবে। কিছু টেস্ট বাকি আছে, সেগুলো করা হবে।

তিনি বলেন, অন্য দেশের প্লান্টের দিকে তাকান। তারা কী করেছে, তাদের ক্ষেত্রে কী কী রিকমেন্ডেশন হয়েছে, তারা কোন কোন, কতটা রিকমেন্ডেশন পেয়েছে। আপনি যদি আন্তর্জাতিক বিশ্বের দিকে তাকান, তাহলে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম রিকমন্ডেশন পেয়েছে।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT