সোমবার ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ছুটির দিনে বাসার তালা ভেঙে রহস্যঘেরা অভিযান

প্রকাশিত : ০৮:২৮ পূর্বাহ্ণ, ১৮ আগস্ট ২০২৪ রবিবার ৮৭ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

সাবেক সচিব শাহ কামালের আদাবরের বাসায় শত শত কোটি টাকা মজুত আছে-সোর্সের মাধ্যমে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য কয়েক মাস আগেই পেয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তখন সরকারের সর্বোচ্চ মহলের অনুমতি পাওয়ার পরও সোর্সের দাবি করা ‘সোর্স মানি’সংক্রান্ত জটিলতায় শেষ পর্যন্ত অভিযান চালায়নি সংস্থাটি। কিন্তু হঠাৎ শুক্রবার ছুটির দিনে ডিবি ও দুদক পরিচয়ে ‘রহস্যঘেরা’ অভিযান নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। তারা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দরজার তালা ভেঙে বাসায় ঢোকে। আবার সকালে অভিযান শুরু করে সন্ধ্যায় সিআইডিকে যুক্ত করার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে, অভিযানের একদিন পর আটক হয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল। শনিবার রাতে রাজধানীর মহাখালীতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখা থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। শাহ কামাল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মহাখালীতে একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে কালো গ্লাসের একটি গাড়ি রাখা ছিল। তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া শাহ আলমের দুর্নীতির ফাইল পরিসমাপ্তি করেছেন দুদকের যে কর্মকর্তা, অভিযানে সাদা পোশাকে তার উপস্থিতি নিয়েও চলছে আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, দুদক ও ডিবি পরিচয়ে অভিযান শুরুর বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা পোশাকধারীরা বাসা থেকে বস্তা ও একাধিক ব্যাগে বিপুল টাকা ভরে নিয়ে চলে যান। এ দৃশ্য দেখে প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সেনাবাহিনীর হটলাইনে কল করে সহযোগিতা চান। সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে পালটে যায় দৃশ্যপট। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানা গেছে, চাকরি জীবনে সবশেষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন শাহ কামাল। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ত্রাণের অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের গোপন অনুসন্ধান করে দুদক উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিযোগটি পরিসমাপ্তি করেন। প্রভাবশালীদের তদবিরে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করা হয়। এই কর্মকর্তাই ছুটির দিনে সাদা পোশাকে অভিযানে ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সেনাসদস্যরা গেলে দুদক কর্মকর্তা ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।

জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অনুরোধে চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশে পুলিশি অভিযানে সহযোগিতা করতে গিয়েছিলাম। কীভাবে জব্দ মালামালের ইনভেন্টরি করতে হয় সে বিষয়ে সহযোগিতা করতেই যাই।’

দুদক চেয়ারম্যানের নির্দেশনার কোনো প্রমাণপত্র আছে কিনা-আর ইনভেন্টরির আগেই আপনি ঘটনাস্থল থেকে কেন চলে এসেছেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সাদা পোশাকে যাওয়াটাই মনে হয় ভুল হয়েছে।’ দুদক ও ডিবি পরিচয়ে ইনভেন্টরির আগেই টাকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমাকে বিপদে ফেলবেন না।’

জানা গেছে, ডিবির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ দলের সদস্যরা এই অভিযানে গিয়েছিল। আভিযানিক দলের নেতৃত্বে ছিলেন টিমের উপকমিশনার চৌধুরী জাবেদ পারভেজ। অভিযানের বিষয়ে জানতে তার মোবাইলে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেন। তবে প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়েই মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন বন্ধ করে দেন।

অভিযানের খবরে ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে সিআইডির একজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে যায় একটি দল। দলের নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জব্দ করা টাকার ইনভেন্টরি করার কাজে সহযোগিতা করতে আমরা গিয়েছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে আমরা গিয়ে দেখি আর্মি ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে। আমরা ভেতরে গিয়ে ইনভেন্টরির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়ে চলে আসি।

শনিবার সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই শাহ কামালের বাড়ির সব ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা খুলে ফেলা হয়েছে। এরপরই বিভিন্ন সময়ে ওই বাসা থেকে মালামাল ভর্তি বস্তা বের করে নিয়ে যেতে দেখেছেন স্থানীয় লোকজন। পাশের বাড়ির একটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শাহ কামালের বাসার সামনে হাইয়েস ব্র্যান্ডের বিভিন্ন কালারের কয়েকটি গাড়ি নিয়ে সাদা পোশাকের কিছু লোক নামেন।

ফুটেজে দেখা যায়, বাড়িটির ২শ গজের মধ্যে আলী রাজ হোটেলের সামনে দুটো হাইয়েস গাড়ি (একটি সিলভার ও একটি কালো রঙের), ওয়াহিদ বক্সের বাড়ির সামনে একটি কাভার্ডভ্যান, একটি সাদা হাইয়েস, আরেকটি পুলিশের গাড়ি থামানো। বাড়ির অপর পাশে তিয়াস জেনারেল স্টোরের পাশের গলিতে হালকা অ্যাশ কালারের দুটি হাইয়েস গাড়ি, জনসেবা ক্লিনিকের সামনে দুটি হাইয়েস ও ভবনটির পেছনে হাজি শ্যামলা স্কুলের গলিতে তিনটি হাইয়েস ব্র্যান্ডের গাড়ি রেখে ভেতরে প্রবেশ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দেওয়া ১৫-২০ জনের একটি দল।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল ১০টা থেকে অভিযান শুরু করে দুপুর দুইটার দিকে দুটি গাড়ি বের হয়ে যায়। বিকাল চারটার দিকে স্থানীয় লোকজনের প্রশ্নের মুখে পড়ে অভিযানে আসা কাউন্টার টেরোরিজম (সিটিটিসি)-এর ডিসি ও দুদক পরিচয় দেওয়া কয়েক ব্যক্তি কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত গাড়িযোগে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। এরপর সাধারণ মানুষ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সেনাবাহিনীকে খবর দিলে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ আসে। আরও জানা যায়, সাবেক এই সচিবের বাড়ির মধ্যে সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তির ফ্ল্যাট রয়েছে। যারা নিয়মিত এ বাড়িতে যাতায়াত করেন। বাড়িটিতে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো সরকার পতনের দিনই খুলে ফেলা হয়।

বাড়ির অদূরে স্বর্ণের দোকানদার শাহজাহান জানান, সকাল ১০টায় একটা হাইয়েস ব্র্যান্ডের গাড়ি এসে বাড়িটির সামনে থামে। প্রথমে ৪-৫ জন গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে প্রবেশ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন গাড়িতে করে সাদা পোশাকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে আরও অনেক লোক ঢোকে। সকাল দশটা থেকে মোট চার ধাপে বিভিন্ন গাড়িতে করে লোকজন এসে বাড়িতে ঢোকে। জোহরের আজানের পর কয়েকজন মুখে মাস্ক পরা লোক বস্তা হাতে নিচে নেমে গাড়িতে উঠে যায়। সিআইডি পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আসার আগে সাদা পোশাকে আসা লোকজন অনেক টাকা সরিয়ে ফেলেছে বলে তাদের ধারণা।

স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তফা জানান, এই বাড়িতে অপরিচিত কোনো ব্যক্তিই প্রবেশ করতে পারত না। কখনো কোনো রংমিস্ত্রি কিংবা সুইপার বা কেউ প্রবেশ করতে হলে তারা দারোয়ানদের কাছে থাকা টালি খাতায় নাম, মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা লিখে তারপর প্রবেশ করতে হতো। এমন হাই সিকিউরিটিসম্পন্ন একটি বাড়িতে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন অপরিচিত লোকজন যাতায়াত করত। যারা গত ৪-৫ দিন ধরে বাড়িতে প্রবেশ করে বস্তায় বস্তায় মালামাল সরিয়ে ফেলে। তাদের ধারণা ওগুলো টাকার বস্তা।

শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বেশ কয়েকটি হাইয়েস ব্র্যান্ডের গাড়িতে করে আসা ব্যক্তিদের কয়েকজন দুপুরের পর থেকে বেশ কয়েকটি বস্তা সরিয়ে গাড়িতে তুলে চলে গেছে। যে টাকা বাড়ি থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে এটা অনেক কম। কারণ সকাল থেকে যারা এসেছিল তারা অনেকগুলো বস্তা ভরা টাকা সরিয়ে ফেলে। অভিযানের বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাইনুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযান চালাতে হলে অবশ্যই অভিযানে যাওয়ার আগে সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করে যেতে হবে। এখন তারা সেটা না করলে অবশ্যই আইনের ব্যত্যয়। আর আদালতের নির্দেশনা ছাড়া কোনো ব্যক্তির তালা ভেঙে পুলিশ অভিযান চালালে সেটাও অপরাধ।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT