রবিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ৩রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৬৮ সরকারি পুকুর দখল করে বহুতল ভবন

প্রকাশিত : ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার ১১৫ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে ডেমরা রোড ধরে কিছুদূর এগোলেই বাঁ পাশে নীল রঙের কাচঘেরা একটি ছয়তলা ভবন। এর প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় তিনটি ব্যাংকের শাখা অফিস। আর তিন থেকে ছয়তলা পর্যন্ত থাই পার্ক চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, পার্টি সেন্টার ও কমিউনিটি সেন্টার। ভবনের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে উন্মুক্ত স্থান।

কাগজ-কলমে এই জমির মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন। জমির প্রকৃতি ‘পুকুর বা জলাশয়’। কিন্তু ভবনের মালিক তুহিনুর রহমান ওরফে নূর হাজির দাবি, কখনোই সেখানে পুকুর-জলাশয় ছিল না।
১৫-২০ বছর আগে ভিটে জমি হিসেবে কিনে তিনি কমপ্লেক্সটি তৈরি করেছেন। রাজউকের অনুমতিও নিয়েছেন।

তবে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নথিতে জায়গাটি যাত্রাবাড়ী মৌজায় খাস খতিয়ানভুক্ত। জমির পরিমাণ ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আরএস দাগ নম্বর নেই। তবে সিটি জরিপে কে বা কারা ২৭৫২ নম্বর দাগ তৈরি করে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ওই জমিতে রাজউক কখনোই ভবনের নকশার অনুমোদন দেয়নি। জায়গাটি ড্যাপে জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত।’ প্রমাণ হিসেবে তিনি ওই জায়গার ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সালের স্যাটেলাইট ইমেজ দেখান, যেগুলোতে জলাশয়-পুকুরের চিত্র ফুটে ওঠে। স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, পুকুরটি ধীরে ধীরে ভরাট হতে থাকে। এরপর সেখানে টিনশেড-ঝুপড়ি ঘর তৈরি হয়। বছর দশেক আগে বহুতল ভবনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘রাজউকের অনেক সরকারি জমিতে একসময় পুকুর-জলাশয় ছিল। দিন দিন সেগুলো বেদখল হয়েছে। কিছু লোক নকল কাগজপত্র তৈরি করে দখল করেছে। এগুলো সব উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু খাস জলাশয় চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোর সবকটিতে পুকুর করা সম্ভব না হলেও খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান বা পার্ক তৈরি করা হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক মাস আগে রাজউকের পক্ষ থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে (ডিসি) খাস পুকুরের তালিকা দিতে অনুরোধ করা হয়। দুই জেলা প্রশাসক তালিকাটি পাঠালে রাজউকের পক্ষ থেকে ২৪ জন কানুনগো ও সার্ভেয়ার জায়গাগুলো পরিদর্শন করেন। সম্প্রতি রাজউক এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজউক এলাকার ৬৮টি পুকুর অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে, যার মধ্যে ঢাকায় ৬২টি। ঢাকার পুকুরগুলোর মধ্যে ভেস্টেড প্রপার্টি হিসেবে চিহ্নিত পুকুর রয়েছে সাতটি, বাকি ৫৫টি খাস পুকুর। নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে তিনটি করে ছয়টি পুকুর অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। পুকুরগুলো ভরাট করে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফিলিং স্টেশন, স্টিল মিল, মার্কেট, গ্যারেজ, ফলের আড়ত, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি। তবে দু-একটি স্থানে এখনও পুকুরের অস্তিত্ব বোঝা যায়। বাকিগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই, একসময় সেখানে পুকুর বা জলাশয় ছিল। পুকুরগুলোর একেকটির আয়তন ৩ শতাংশ থেকে প্রায় ১৫ বিঘা পর্যন্ত।

রাজউকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে রাজধানীর ধলপুরে গিয়ে দেখা যায়, ব্রাহ্মণচিরণ মৌজার একটি জলাশয়ে গড়ে উঠেছে চারতলা ভবন। নিচতলা ও দোতলার কাজ শেষ। বেজমেন্টে অটোরিকশার গ্যারেজ। ভবনের মূল মালিক তছলিম উদ্দিন থাকেন দোতলায়। গ্যারেজ পরিচালনাকারী মো. শফিক জানান, বেজমেন্ট ভাড়া নিয়ে তিনি সেখানে গ্যারেজ বানিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, পুকুর ছিল বলে মাটি খুঁড়ে ভবনের বেজমেন্ট তৈরি করতে হয়নি। দোতলায় গিয়ে তছলিম উদ্দিনের বাসা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। ডিসি অফিসের নথিতে তছলিম উদ্দিনের দখল করা জমির পরিমাণ ২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। জমির আরএস দাগ নেই। সিটি জরিপে দাগ নম্বর ২১১০।

যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা কাঁচাবাজারের পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে একটি ফলের মার্কেট। শখানেক আড়তে পাইকারি ফল বিক্রি হয়। একেকটি আড়তের মাসিক ভাড়া ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। প্রতিটি আড়ত টিনশেডের। সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘একতা ফল মার্কেট বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’। মার্কেটের কোনায় একটি দোতলা ভবনে চলে সমিতির কার্যক্রম। সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জানান, জায়গাটির মালিক কে, তা তিনি জানেন না। তবে রানা সরকার নামের একজনকে ঘর ভাড়া দেন আড়তদাররা।

এই রানার সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, মার্কেটের ভেতরে আরেকটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘একতা ফল মার্কেট, পরিচালনায় রানা সরকার’। সাইনবোর্ডের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে রানা সরকার বলেন, ‘এই জমির মালিকানা নিয়ে একটু ঝামেলা আছে। জমির মালিক বিএনপি নেতা নবী উল্লাহ নবীর সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের মামলা আছে। নবী উল্লাহ নবীর পক্ষে আমি জায়গাটি দেখাশোনা করি। সংসদ নির্বাচনের আগে গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের মামলায় কারাগারে রয়েছেন নবী উল্লাহ নবী। ডিসি অফিসের নথি অনুযায়ী, সিটি জরিপে ওই জমির দাগ নম্বর ৪৮০৮। জমির আয়তন ৮৫ দশমিক ৩২ শতাংশ, প্রকৃতি খাস পুকুর।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘এসব পুকুর যাতে ভরাট বা অবৈধ দখলে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব ছিল ডিসি অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও ভূমি অফিসের। তাদের ব্যর্থতার কারণে আজ খাস পুকুরগুলো ভরাট হয়েছে। যারা পুকুর ভরাট করেছে এবং যাদের ব্যর্থতায় ভরাট হয়েছে, উভয়কে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

উল্লেখযোগ্য দখল-ভরাট

রাজউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিরপুর সার্কেলের বসুপাড়া মৌজার আরএস ৬০১ নম্বর ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশের খাস পুকুরে কয়েক ব্যক্তি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। ছোট দিয়াবাড়ী মৌজার সাড়ে ৭ শতাংশ পুকুরেও টিনশেড ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন কয়েক ব্যক্তি। মিরপুর মৌজার ১৫ শতাংশ পুকুরে অস্থায়ী টংঘর বানানো হয়েছে, আর কিছু অংশ পার্কিং হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাউনিয়া মৌজার ৭৮ শতাংশ জলাশয়ের কিছু অংশে বাউনিয়া ভূমি অফিস, কিছু অংশে আলফাত্তাহ মসজিদ এবং বাকি অংশে কয়েকজন সেমিপাকা ও টিনশেড ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। চণ্ডালভোগ মৌজার ৬৩ শতাংশ পুকুর পুরোটা ভরাট করে কিছু অংশে একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অফিস করা হয়েছে।

টং দোকানও আছে কয়েকটি। দিয়াবাড়ী মৌজার সাড়ে ৪৫ শতাংশের পুকুরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সূত্রাপুর মৌজায় ২৯৮৪ দাগের সাড়ে ৬৫ শতাংশ জলাশয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খেলার মাঠ বানিয়ে দিয়েছে। মাঠটি সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ নামে পরিচিত। কোতোয়ালি থানার ঢাকা মৌজার ৫৩৫৮ দাগের ১৮ শতাংশ জলাশয়ের সামান্য কিছু অংশে পুকুর দৃশ্যমান। বাকি অংশে হয়েছে ছোট-বড় স্থাপনা। ওয়ারী মৌজার ৪২৪৭ দাগের খাস পুকুরটি এখন কামরুন্নেছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। একই মৌজার ৫৪৮১ দাগের জলাশয়ে একটি বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে।

ওয়ারী মৌজার ৪১৬৩ নম্বর দাগের ৫১ শতাংশ পুকুরে হয়েছে মুন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের কার্যালয়। আইলবহর মৌজায় ১৯৪ দাগের সোয়া ৫ শতাংশ পুকুরে দোতলা ও টিনশেড সেমিপাকা ঘর হয়েছে। সূত্রাপুর মৌজার ২০০০৫ নম্বর দাগের ৭০ শতাংশ পুকুরে হয়েছে একটি ফ্লাওয়ার মিল। জুরাইন মৌজার ৪৮১০ দাগের সাড়ে ৯ শতাংশ পুকুরে হয়েছে একতলা টিনশেড ও সেমিপাকা স্থাপনা। মতিঝিল সার্কেলের আরএস ১৭৬০ দাগের ২১ শতাংশ জলাশয়ে তৈরি হয়েছে সেমিপাকা ঘর ও তিন থেকে ছয়তলা ইমারত। মাণ্ডা মৌজার ১৮২৫ নম্বর দাগের পুকুরটি হলি ক্রস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও স্কুলের মাঠ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

রাজারবাগ মৌজার ৭৩৪০ দাগের ১১ শতাংশ জলাশয়ে টিনশেড ঘর, সেমিপাকা দু-তিনতলা ভবন ও কিছু অংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। কদমতলী মৌজার ৯৭১৩ নম্বর দাগের ৪৮৮ শতাংশ পুকুরে গড়ে উঠেছে আইটিএস সিএনজি ফিলিং স্টেশন, দোতলা বাণিজ্যিক ভবন ও একটি স্টিল ইন্ডাস্ট্রি। কদমতলী মৌজার ৯৩০১ দাগের ১৯৭ শতাংশ জলাশয়ে হয়েছে টিনশেডের একাধিক স্টিল ইন্ডাস্ট্রি। দক্ষিণগাঁও মৌজার ১৯০৪ দাগের পুকুরে গড়ে উঠেছে ওয়াসার পানির পাম্প। রাজারবাগ মৌজার ৯০১০ দাগের ৫ শতাংশ জলাশয়ে গড়ে উঠেছে একটি আবাসিক ইমারত। দনিয়া মৌজার ৭৭৮২ দাগের ২১ শতাংশ পুকুরে গড়ে উঠেছে রিকশার গ্যারেজ ও অস্থায়ী টিনশেড ঘর।

এ ছাড়া ব্রাহ্মণচিরণ মৌজার ২৪৩৩ দাগের ২ শতাংশ জলাশয়ে গড়ে উঠেছে সেমিপাকা টিনশেড ঘর ও ওয়ার্কশপ। নারায়ণগঞ্জের মখণ্ড মৌজার ১৭০৩ দাগ ও আশপাশের পাঁচটি দাগের ২৫০ শতাংশের পুকুরটি খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কিছু অংশ খালিও রয়েছে। দ্বিগুবাজারের নারায়ণগঞ্জ মৌজার ১১৪ থেকে ১১৭ নম্বর দাগের ২৪০ শতাংশ জলাশয়ের কিছুটায় খেলার মাঠ ও বাকি অংশে একতলা থেকে চারতলা ভবন করা হয়েছে। জমিটিতে ‘অগ্রণী ব্যাংকের নিজস্ব সম্পত্তি’ দাবি করা একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়।

নারায়ণগঞ্জের বড়পুকুর মৌজার ১৫১০ ও ২৩৫ নম্বর দাগের ৫১১ শতাংশ জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মন্দির, পুকুর, টিনশেড ঘর ও দোকান। রমনার আরএস ৩৯৫ দাগের পুকুরটি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। হাজারীবাগ মৌজার আরএস ৯৮৬৯ নম্বরসহ কয়েকটি দাগ ও আরএস ৫৮০ নম্বর দাগে থাকা দুটি পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একই মৌজার ১৬৬৫ ও ১৬৬৮ আরএস দাগে থাকা পুকুরেরও অস্তিত্ব নেই। লালমাটিয়া মৌজার এসএস ২৫৬৬ নম্বর দাগের পুকুরটিতে এখন বিবির শাহি মসজিদ। এ ছাড়া আরও অনেক খাসপুকুর অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

এই বিভাগের জনপ্রিয়

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT