মঙ্গলবার ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৬শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘ভূকম্পনের বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ’

প্রকাশিত : ০৬:০৭ অপরাহ্ণ, ৩০ আগস্ট ২০২৩ বুধবার ১০৯ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

আবারও সিলেট মহানগরীর আশপাশে মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর আগে ১৪ আগস্ট সোমবার রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ মাত্রা। যার উৎপত্তিস্থল ছিল আসামের মেঘালয়। গত পাঁচ মাসে দেশে একাধিক ছোট মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫ বছরে ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প হয়েছে ১৪৬ বার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সাধারণত প্রতি একশ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই হিসেবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও ভূমিকম্প মোকাবিলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়লে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনে সর্কড হয়ে বেশি মানুষ মারা যাবেন। দেশের অন্য বড় শহরগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ঘন ঘন ছোট ও মাঝারি ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো উৎস হচ্ছে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকা। এখান থেকে মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারে যে পার্বত্য এলাকা রয়েছে সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেট নামে দুটি টেকটনিক প্লেটের অবস্থান রয়েছে। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান প্লেটটি উত্তর-পূর্ব দিকে এবং বার্মিজ প্লেটটি পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। ফলে পরস্পরমুখী সংঘর্ষ হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের যে সংযোগস্থল সেটা বেশ গভীরে। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে বিশেষ করে সিলেট এলাকায় যেখানে ভূমিকম্প হচ্ছে সেটা স্যালো ডেপথ, অর্থাৎ কম গভীর।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে যেগুলে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। দুই দিন আগে বা পরে এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো। আর সে কারণেই ঘন ঘন এমন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয় রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায়। এর আগে, গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। মে মাসের ৫ তারিখে আরেকটি ভূমিকম্প হয় ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের হিসেব অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটিরও গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল পূর্ব মিয়ানমারের মাউলাইকে। ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ঘন ঘন এমন ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে আতংক তৈরি হচ্ছে।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার জিওসায়েন্সে বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ভূগর্ভে যে পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে, তাতে সিলেট অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই দ্রুত দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ লাখ বহুতল ভবনের সব কটিকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া একটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির লক্ষণ। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জরুরি ভিত্তিতে সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, তার মহড়া দেওয়া শুরু করতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি ও মহড়াকে নিয়মিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ও ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি-মানে এই নয় যে, আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই দ্রুত প্রস্তুতি ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

অধ্যাপক মেহেদী আরও বলেন, ‘দেশের ভিতরে ও বাইরে মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন আছে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২ থেকে ৩টি ফল্ট লাইন আছে। দেশের ভেতরেও বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে। গত চার-পাঁচ মাসে আমরা যে ভূমিকম্পগুলো দেখছি। এই সবগুলোই হচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ভূমিকম্প। এটা সাবডাকশন জোনের লকড সেগমেন্টে হচ্ছে। এটার মানে হচ্ছে, বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’

ভূমিকম্প নিয়ে রাজউকের সমীক্ষায় বলা হয়, মধুপুর চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় মারা যেতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ। ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান দুটি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখার ওপরে। একটি ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে কাছে টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতিরেখা অন্যটি সিলেট অঞ্চলের ডাউকি চ্যুতিরেখা। ঢাকা মহানগরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা আওতায় নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবেন ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে ৫ বিলিয়ন ডলার যা সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কৈাটি টাকা)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে ভূমিকম্প হলে মানুষের মৃত্যু বেশি হবে। কারণ, এই সময় বাণিজ্যিক ভবন ও কারখানায় মানুষ বেশি থাকেন। আর ঢাকায় ভবনগুলোর ধসে পড়ার ঝুঁকির কারণ, অনেক ভবন জলাভূমি ভরাট করে নরম মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। আবার নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভূমিকম্পসহনীয় করা হয়নি। অনেক ভবনই অবৈধভাবে নির্মিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক কারণে দেশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। কারণ, ভূ-চ্যুতিগুলো এ চার অঞ্চলে সন্নিহিত। অতীতে যেসব বিধ্বংসী ভূমিকম্প বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে সেগুলোর উৎপত্তিস্থলই ছিল সীমান্তবর্তী এসব প্লেট বাউন্ডারির চ্যুতি এবং দেশের ভেতরের ডাউকি ও মধুপুর চ্যুতি।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT