রবিবার ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিদেশি বিনিয়োগে ৭ বড় বাধা

প্রকাশিত : ০৬:০৮ পূর্বাহ্ণ, ৭ মে ২০২৩ রবিবার ১১৯ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা সাতটি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দুর্নীতি। এরপরেই আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এর বাইরেও বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেছেন।

বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে এফডিআই বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ) এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিট পুঁজি ১৩৫ কোটি ডলার। যা মোট এফডিআইর ৩৯ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৫১ কোটির মধ্যে নিট পুঁজি ৮২ কোটি ডলার। যা মোট এফডিআইর ৩৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৩৭ কোটির মধ্যে নিট পুঁজি ৭৩ কোটি ডলার। মোট এফডিআইর ৩১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৮৯ কোটি ডলারের মধ্যে নিট পুঁজি ১২০ কোটি ডলার। যা মোট বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ।

গত দুই অর্থবছরে এফডিআই কিছুটা বাড়লেও হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এফডিআইর বড় অংশই এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ ও অর্জিত মুনাফা থেকে এসেছে। মোট বিনিয়োগের মধ্যে নিট পুঁজি হিসাবে আসে ৩০ থেকে ৩৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করায় বিনিয়োগের দুয়ার খুলছে না।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আগে দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। দেশি বিনিয়োগকারীদের দেখে বিদেশিরা এগিয়ে আসবেন। তাদের মনে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। দেশের ভালো ইমেজ গড়ে তোলা জরুরি। তা হলেই শুধু বিনিয়োগ আসবে। শুধু এক-দুটি পদক্ষেপ নিলে বিনিয়োগ আসবে না।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা প্রথমেই বড় বাধায় পড়েন যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সাধারণত দেশে বিদেশি বড় বিনিয়োগ আসে দেশি উদ্যোক্তার হাত ধরে। কিন্তু দেশের বিনিয়োগকারীরা যৌথ উদ্যোগে কারখানা করতে আগ্রহী নন। তারা একক মালিকানায় শিল্প স্থাপনেই আগ্রহী বেশি। ফলে বিনিয়োগ সম্মেলন, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক হয় তাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।

উদ্যোক্তার মতে, ব্যবসায় নানা জটিলতা রয়েছে। কারখানা চালাতে স্থানীয় পর্যায়ে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। কেন্দ্রীয় অফিস থেকেও নানা ঘাটে চাঁদার চাহিদা মেটাতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়।

বর্তমানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট প্রকট। চড়া দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগুলোর সরবরাহ মিলছে না। অবকাঠামোগত সমস্যা তো আছেই। এগুলোর মধ্যে বিদেশিদের ডেকে এনে বিপদে ফেলতে হবে। এ কারণে অনেকেই বিদেশিদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছেন না।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানিতে কর ও কোটা সুবিধা পাওয়ায় দেশে গার্মেন্ট খাতে অনেক বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু গার্মেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা এর বিরোধিতা করেছেন। তারা বলছেন, বিদেশিরা প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করুক। দেশে মৌলিক ও বড় শিল্প স্থাপন করাও জরুরি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরেই বিদেশি বিনিয়োগ আনা সহজ। এ কারণে দেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিদেশি উদ্যোক্তাদের একটি সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে হবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ আসা সহজ হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানর সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে ও দারিদ্র্য দূর করতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষায়ও তা জরুরি। এজন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের যে সংকট এটি চলতে থাকলে বিনিয়োগ আসবে না। এগুলোর সমাধান করতে হবে দ্রুত।

সূত্র জানায়, দেশে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ আসছে সেগুলোর বড় অংশই সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে। এর মধ্যে সীমিত পর্যায়ে দেশি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। বিদেশিরা দেশে এসে আলোচনায় নানা বাধার সম্মুখীন হন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি। বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এসব অনুমোদন নিতেই বাধে যত বিপত্তি।

বড় ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় দরকষাকষির পর চাহিদা অনুযায়ী সুবিধা না পেয়ে অনেকে পিছু হটেছেন। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির নিশ্চয়তা না পেয়েও অনেকে ফিরে গেছেন। এসব সমস্যা মিটিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেই পড়েন দুর্নীতির ফাঁদে। নানা ঘাটে উপরি দিতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খাত ভেদে ১৬ থেকে ৩২ ধরনের সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে দুর্নীতি, তেমনি আছে সময়ক্ষেপণ। এতে উদ্যোক্তার খরচ বেড়ে যায়। উদ্যোক্তারা এটিকে অন্যতম বাধা মনে করেন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় ৫০ ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত জটিলতা বেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এসব সেবা পেতে বিলম্ব হচ্ছে। সেখানে দুর্নীতির নানা সুযোগও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিডাকে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন সনদ দেওয়ার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে এগুলোর বাস্তবায়নের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে মাঠপর্যায়ের সমস্যা কমবে না।

দেশে বিনিয়োগের জন্য জমি কেনা একটি জটিল প্রক্রিয়া, দামও বেশি। এতে আইনি সমস্যাও অনেক। এগুলো সমাধানে অনেক সময় লাগে। এক্ষেত্রেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

কর সংক্রান্ত জটিলতাও সমস্যা। আইনের অস্পষ্টতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হন। বিনিয়োগে দুর্বল অবকাঠামোও বড় সমস্যা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। ফলে ওইসব এলাকায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশে বিনিয়োগ করতে জমি কেনাসহ নানা খাতে জটিলতা বেশি। ওই দুই এলাকার বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঋণ নিতে হয়। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নেই। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে গেছে। এছাড়া প্রায় এক দশক আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করতে উৎসাহিত করেছিল। প্রথমে এটি বেশ গতি পেলেও এখন থেমে গেছে। ব্যাংক ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ের অভাবে সিন্ডিকেশন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না।

বিদেশি বিনিয়োগে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও অনিশ্চয়তা আছে। এতে দেশি বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে রয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বিনিয়োগ আকর্ষণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা জরুরি বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া সরকার বদল হলে নীতিরও বদল হয়ে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়েন। এ কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে অভিন্ন নীতি প্রণয়ন জরুরি।

গত বছরের মাঝামাঝি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রায় সব স্তরেই দুর্নীতি আছে বলে ব্যাপকভাবে অনুমান করা হয়, যা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। এছাড়া বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের দুর্বল প্রয়োগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল অবকাঠামো ও বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের সক্ষমতার অভাবকে অন্যতম সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সরবরাহের সংকটের কথাও বলা হয়েছে।

প্রায় কয়েক বছর আগে বিনিয়োগের জন্য ১৬টি বাধা চিহ্নিত করেছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব বাধা দূর করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তেমন কোনো কার্যকর ফল আসেনি। চিহ্নিত বাধাগুলোর মধ্যে ছিল- কারখানা স্থাপনে পর্যাপ্ত জমির অভাব, বিদ্যুৎ ও গ্যাস প্রাপ্তিতে সমস্যা, দুর্বল অবকাঠামো, চাহিদা ও সময়মতো ঋণ না পাওয়া, কাঁচামালের সমস্যা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, পণ্য বিপণনে সমস্যা, যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তার অভাব, অসম প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র গ্রহণে জটিলতা, বিভিন্ন ধরনের কর সমস্যা, নীতির অস্পষ্টতা, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের জোগান কম উল্লে­খযোগ্য।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT