বুধবার ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৭শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আগুনের কান্না থামছে না ব্যবসায়ীদের, বাড়ছে আতঙ্ক

প্রকাশিত : ০৫:৪১ অপরাহ্ণ, ১৯ এপ্রিল ২০২৩ বুধবার ১২০ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

রাজধানীতে ভয়াবহ আগুনে একের পর এক মার্কেট পুড়ে ছাই হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কখন কীভাবে আগুন লেগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সারা জীবনের সঞ্চিত মূলধন পুড়ে অন্যান্য মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের মতো পথে বসতে হয় এ দুশ্চিন্তায় অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিশেষ করে অবৈধ জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন।

ব্যবসার এই ভর মৌসুমে দোকানিরা গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা করে নগদ অর্থ আগে দোকানের ক্যাশ বাক্সে কিংবা লকারে রেখে গেলেও ভোর রাতের রহস্যজনক আগুন আতঙ্কে অনেকে এখন ঝুঁকি নিয়ে তা বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। যারা এ ধরনের ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছেন, এমন অনেক দোকান মালিক নগদ টাকা সঙ্গে নিয়ে মার্কেটের দোকানের ভেতরে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন। সকালে ব্যাংক খোলার পর তা সেখানে জমা দিয়ে পরে বাসায় ফিরছেন।

মৌচাক মার্কেটের ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম বলেন, ছিনতাইয়ের ভয়ে লাখ লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা যায় না। আবার দোকানে রাখতেও সাহস পাই না। তাই নগদ টাকা নিয়ে দোকানেই জেগে রাত কাটাতে হচ্ছে। যাতে আগুন লাগলে অন্তত ক্যাশ টাকা নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারি।

এদিকে গভীর রাত ও ভোরের দিকের রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্কে রাজধানীর প্রতিটি মার্কেটেই সিকিউরিটি গার্ডের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অত্যাধুনিক বড় মার্কেটগুলোতে প্রয়োজন মতো সিসি ক্যামেরা বসিয়ে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। দোকানিরা অনেকে নিজ উদ্যোগে ফায়ারস্টিংগুইসারসহ অন্যান্য অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি কিনেছেন। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য মার্কেট কমিটিকে দোকানিরা চাপ দিচ্ছেন। বহিরাগত কেউ যাতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আগুন ধরিয়ে দিতে না পারে এজন্য মার্কেটের প্রবেশ পথগুলোতেও তীক্ষ নজর রাখা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় খোদ প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব ঘটনা ষড়যন্ত্র বা নাশকতা কি না তা তিনি তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন তিনি। পাশাপাশি দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া এসব অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের বিষয়টি জড়িত আছে কি না তাও প্রধানমন্ত্রী তদন্ত করে দেখতে বলেছেন। তাই এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা অতীতেও বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে শত শত ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়েছেন। এ কারণে তাদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে।

রাজধানীর বঙ্গবাজার এবং নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই গাজীপুরের টঙ্গী বাজারের সফুরা মার্কেটে ‘পরিকল্পিতভাবে’ আগুন দেওয়ার তথ্য পাওয়ার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, ১২ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে সফুরা মার্কেটের নিচতলার পাইকারি মার্কেটে আগুন লাগলেও তা ছড়িয়ে পড়ার আগেই দোকানদাররা তা নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হন। তা না হলে এ মার্কেটের তিনশ’ ব্যবসায়ীকেও পথে বসতে হতো। অথচ এ আগুন দুর্ঘটনাক্রমে লাগেনি। সন্দেহভাজন এক যুবক নাশকতামূলকভাবে আগুন ধরিয়েছে। যা মার্কেটের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মার্কেটের প্লাস্টিকের একটি দোকানের মালামালের স্তূপের নিচ থেকে পেট্রোল ভর্তি বোতলও উদ্ধার করা হয়েছে।

সরেজমিন রাজধানীর প্রায় এক ডজন মার্কেট ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার পর ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে নতুন করে একাধিক কমিটি করছেন। বাড়িয়েছে ফায়ার ফাইটারসহ নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা। আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি সচল এবং সেগুলো রিফিল করাসহ সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় মার্কেটের রিজার্ভারে অতিরিক্ত পানি মজুত রাখা হচ্ছে।

এদিকে শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রশাসনেও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি মার্কেটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

ডিএমপির উপকমিশনার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি মার্কেটে ভোররাতে পোশাক পরিহিত পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা টহল বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। মার্কেটের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা সচল রাখা ও ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চিহ্নিত নাশকতাকারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখার পাশাপাশি এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা গেছে, ঢাকা অঞ্চলের ৫৮টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। এই তালিকায় রাজধানী ঢাকায় ৯টি মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গত দুই সপ্তাহে ৫৮টি ভবন হালনাগাদ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবছর এটি হালনাগাদ করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ভবন মালিককে জানানো হয়। চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান না করলে ফায়ার সার্ভিস ব্যানার টানিয়ে দেয়। যেন জনগণ সচেতন হয়।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলো নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নেভাতে পারছি না। মার্কেটগুলোতে মহড়া না করার কারণে আমাদের যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করতে পারছি না।’ তিনি সবাইকে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও মহড়া এবং মার্কেটের প্রতিটি স্থানে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান। অতিরিক্ত দাবদাহের কারণে বস্তুর দাহ্য হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বলে জানান তিনি।

এদিকে ব্যবসায়ী নেতারা জানান, মার্কেটের দোকানিদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক এতটাই জেঁকে বসেছে যে, অনেকেই ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছেন না। বিগত সময় ঈদের আগে দোকানিরা সাধারণ চাহিদার কয়েকগুণ বেশি মালামাল মজুত করলেও এবার অনেকেই সেই সাহস পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা এক-দুই দিনে বিক্রি হবে এই পরিমাণ পণ্য দোকানে মজুত করছেন। এতে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আতঙ্ক আর সন্দেহ নিয়ে ব্যবসা চালানো যায় না। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের ঘটনায় শুধু এই দু’টি মার্কেটের ব্যবসায়ীরাই নন, সারা দেশে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ব্যবসায়ীদের ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনা সারা দেশের ব্যবসায়ী, বিশেষ করে পুরো ঈদ বাজারকে চরম ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না এই ব্যবসায়ী নেতা।

এদিকে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ঈদের আগ মুহূর্তে এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বারবার এসব ঘটনার পেছনে কোনো নাশকতা রয়েছে কি না তা গোয়েন্দা সংস্থাকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।

সোমবার দুপুরে গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ঈদের কেনাকাটা করতে খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটে আসা শিউলি বেগম জানান, পর পর কয়েকটি মার্কেটে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় তার পরিবারের ঈদ কেনাকাটা করার আনন্দ উবে গেছে। পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় কোনো মার্কেটে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাই অল্প সময়ের মধ্যে কিছু পোশাক কিনতে তালতলা মার্কেটে এসেছেন। কিন্তু এখানে আসার পর এটিও ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় রয়েছে বলে জেনেছেন।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT