বুধবার ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৭শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তাপদাহে কৃষি বড় বিপদে

প্রকাশিত : ০৫:২০ পূর্বাহ্ণ, ১৮ এপ্রিল ২০২৩ মঙ্গলবার ১১৪ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

পাকতে শুরু করেছে বোরো ধান। ক্ষেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তরমুজ-বাঙ্গি। গাছে গাছে লিচু, কাঁঠাল, আম। চিচিঙ্গা, ঝিঙে, পটোল, টমেটোসহ গ্রীষ্মকালীন সবজিও মাঠে ভরপুর। দেশে সবচেয়ে বেশি ফল পাকে এপ্রিলে। আগামী ১২ মে থেকে পাকা আম যাবে বাজারে। তবে কৃষি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে আগুন-গরমে দুশ্চিন্তা ভর করেছে কৃষকমনে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ঝলসে যাচ্ছে ফসল। ঝরে পড়ছে আম ও লিচুর গুটি। বৃষ্টি না থাকায় সেচকাজে অতিরিক্ত খরচের কারণে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়ও। অন্যদিকে ভোরে ঘন কুয়াশা আর দিনে তীব্র গরম– এমন বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা।

বোরোর ভালো ফলন হবে এবার, এমনটা আশা সবার। এ মৌসুমে ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ২ কোটি ১০ লাখ টন। ইতোমধ্যে হাওরে ধান কাটা শুরু হলেও দেশের অন্য অঞ্চলে আরও সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। ঠিক এ সময়ে দেশে তীব্র তাপদাহ ও খরা চলতে থাকায় আশাতীত বোরো ফলনের ব্যাপারে অনেক কৃষক শঙ্কিত।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২ এপ্রিলের পর দেশের কোথাও বৃষ্টি হয়নি। উল্টো টানা ১৭ দিন তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দেশের ৯০ শতাংশ এলাকায়। খরার কারণে অঞ্চলভেদে ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। এতে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। চাষিরা জানান, ক্ষেতে পানি না থাকায় ধানে চিটা ধরছে। ধানের শীষ ও পাতা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না তাঁরা।

রাজশাহীর চারঘাটের বরকতপুর গ্রামের কৃষক কলিম উদ্দিন বলেন, গত বছর ডিজেলচালিত নলকূপে প্রতি ঘণ্টা সেচের খরচ ছিল ১২০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ বছর নিচ্ছে ২০০ টাকা। তবে বাড়তি টাকা দিয়েও পানি ঠিকমতো মিলছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আগে এক ঘণ্টায় যা পানি পাওয়া যেতো এখন তা দুই ঘণ্টাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, ‘তীব্র খরায় আম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। গাছের গোড়ায় রস না থাকায় বোঁটা শুকিয়ে আম ঝরে যাচ্ছে।’ চারঘাটের চৌধুরীর বিলের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বরেন্দ্রের গভীর নলকূপ থেকে সারারাত মাছচাষের পুকুরে পানি দেওয়া হয়। সকালে আমরা ধানচাষিরা পানি চাইলে নলকূপ নষ্টসহ নানা বাহানা ধরে অপারেটররা। বাধ্য হয়ে ডিজেলচালিত মেশিন দিয়ে ধানে পানি দিচ্ছি। সারারাত গভীর নলকূপ চলার কারণে দিনে শ্যালো মেশিনে পানি উঠতে চায় না।’

রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা বলছেন, গত কয়েকদিনের খরায় প্রায় ৩০ শতাংশ আম ও লিচুর গুটি ঝরে পড়েছে। তবে সরকারিভাবে ঝরে পড়ার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, অপরিপক্ব অবস্থায় ফল ঝরে পড়া ও ফলের আকার ছোট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যার খবর পাওয়া গেছে। পাট ও ভুট্টা উৎপাদনেও প্রভাব পড়ছে। নওগাঁ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রিজিওন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, জেলায় বিএমডিএর ৪ হাজার ১০৩ গভীর নলকূপের মধ্যে ৪ হাজার ৮৫টি চালু আছে। তবে নদীতে স্থাপন করা প্রায় ৪০০ এলএলপি পানি না থাকায় তা বন্ধের পথে। গতকাল এ মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীতে। পাবনা সদর ও ঈশ্বরদীতে এবার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, খরায় প্রতিদিন গাছ থেকে ঝরে পড়ছে অপরিপক্ব আম ও লিচুর গুটি। কৃষি বিভাগ জানায়, কয়েক বছর ধরে ৪ থেকে ৫শ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন হয় শুধু পাবনা ও ঈশ্বরদীতে। এ মৌসুমে এমন আশা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে চাষিরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

এদিকে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের কাছে লাভজনক ফসল তরমুজ এখন হতাশার নাম। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে প্রতি বছর চাষিদের উৎপাদিত তরমুজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। তবে এ বছর তীব্র গরমে তরমুজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিনির্ভর পাটের আবাদে এবার খরার কারণে সেচ দিতে হচ্ছে। বাড়তি সেচ দিয়েও পাট বাঁচানো যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে, বিশেষত কৃষি খাতে এ প্রভাব আরও অনেক বেশি। ২০২১ সালে বয়ে যাওয়া হঠাৎ গরম বাতাসের প্রবাহে (হিটশক) ৫৫ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ধান আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি খরার মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমির ফসল খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় হয় বলে গত বছর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় উঠে আসে। গবেষণায় বলা হয়, কম বৃষ্টির কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে কৃষি পরামর্শ সেবা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শস্যের ফলন ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে কৃষকের আয় ৩১ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ ধানচাষি আবহাওয়ার পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা নিচ্ছেন জানিয়ে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সবাই এ পূর্বাভাস পেলে ফলন ৭ শতাংশ বাড়বে। ব্রির এক সতর্কবার্তায় (১১ থেকে ১৭ এপ্রিল) বলা হয়েছে, দেশে যে তাপদাহ চলছে, তাতে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের ধান ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে। ধানের পরিপক্ব পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা দানা গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে ফলন কমে যায়।

ব্রির মহাপরিচালক শাহজাহান কবির বলেন, হাওরে বেশিরভাগ ধান পেকে গেছে। সেটার ক্ষতির আশঙ্কা কম। তবে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় ধান পরে লাগানো হয়। সেখানে এই তাপদাহের সময়ে খুব সাবধানে ধানের পরিচর্যা করতে হবে। অবশ্যই জমিতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত তামপাত্রায় যেকোনো ফসলের পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, খরার কারণে উৎপাদনে সামান্য প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে কোনো ঘাটতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা নেই। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের অনারারি নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসেন বলেন, নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম, একই সঙ্গে বৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় গাছের অভাব; এ বিষয়গুলো অনাবৃষ্টির জান্য দায়ী। নতুন করে দেখা গেছে বাংলাদেশে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ মিথেন কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি, যা বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষির এই সংকট নিয়ে আমি নিজেও উদ্বিগ্ন। আমরা জলবায়ুসহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছি। এবার গরমের কারণে কিছু ফসল নষ্ট হচ্ছে। তবে তা মোট উৎপাদনে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। হাওরে যাতে দ্রুত সময়ে ফসল কাটা যায়, সে জন্য সেখানে প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্র দেওয়া হয়েছে।’

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT