রবিবার ১২ মে ২০২৪, ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা সংকট

প্রকাশিত : ০৮:৩০ পূর্বাহ্ণ, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ রবিবার ৭ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে বাংলাদেশ সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে; কারণ সময় ও সুযোগ হাতছাড়া হলে আফসোস করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারে যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, সেহেতু আরাকান আর্মির সঙ্গে দরকষাকষির একটা সুযোগ বাংলাদেশ এ মুহূর্তে নিতে পারে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান হিসাবে পুনর্বাসনের কথা বলে আসছে।

২০২২ ও ২০২৩ সালে মিয়ানমার থেকে কিছু উদ্যোগ ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং ক্যাম্প ও বসতি পরিদর্শন সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশা হ্রাস পাচ্ছে। একদিকে কার্যকর উদ্যোগের অভাব, অপরদিকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ও নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর সংশয় দেখা দিচ্ছে। এর কারণ কি আসলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া? নাকি এ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে সমস্যাটিকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে পারে?

মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং আরাকান সেনাবাহিনীর সাফল্য বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি, মিয়ানমারের দ্বৈতনীতি ও কারসাজিমূলক আচরণ এবং এশিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের ভূমিকা।

তবে বেশকিছু পশ্চিমা সংবাদপত্রের বিশ্লেষণে যেভাবে বলা হচ্ছে, এক বছরের মধ্যে মিয়ানমার জান্তার পতন ঘটবে এবং মিয়ানমারের গেরিলা নেতারাও সেই দাবি করছেন, তা খুব বাস্তবসম্মত মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে, দেশটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে জান্তার যে নিয়ন্ত্রণ, তার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়নি। যেসব জায়গায় তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা মূলত জাতিগত অঞ্চলভিত্তিক এলাকা এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চল। কাজেই মিয়ানমার বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হবে, এটি এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

আরাকান আর্মি দক্ষিণ চিন প্রদেশের পালেতোয়ায় নিজেদের পতাকা উড়িয়েছে-বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সামরিক সরকারের অধীনে থাকা অন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলও। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাখাইনে আরাকান আর্মির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এতেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন আশা করা বাড়াবাড়ি।

সংঘাতময় এ পরিস্থিতির গোড়ার দিকে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী যখন বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়, তখন চীনা রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছিলেন, বেইজিং যেভাবে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার ব্যাপারে কাজ করছে, তা শিগ্গির রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দরজা উন্মোচন করবে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে বিবিধ কারণে।

আরাকান আর্মির সাফল্য এবং মিয়ানমারের সম্ভাব্য নতুন বাস্তবতার প্রত্যাশা অনেকে করছেন। তাদের এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক, মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়েই রোহিঙ্গা গণহত্যার অপরাধে অপরাধী। উভয়ের কাছেই রোহিঙ্গারা ‘অবৈধ বাঙালি’। বাংলাদেশে যে মাদক প্রবেশ করে, তার একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মি। কিছুদিন পরপর মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের আটক করা হয় বটে; তবে এ মাদকের উৎপাদন, বিপণন তথা পরিবহণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরো কাজটি হয় আরাকান আর্মি ও সামরিক জান্তার ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু নাম হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের।

বাংলাদেশ এখনো শরণার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি। বাংলাদেশ শরণার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কের দায়িত্ব পালন করে এবং তাদের আবাসন, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে। তবে এখনো কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। উল্লেখ্য, প্রধানত কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে সিরিয়ার শরণার্থীদের জর্ডানে শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি এবং কোনো নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। এতে করে জটিলতা বেড়েছে এবং একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা আরোপিত শর্ত কবুল করে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা করতে হয়েছে। এর পরিণতি খুব ভালো কিছু হয়নি। এ বিষয়টি থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সক্ষম হতে পারে, যদি সরকার সব দিক বিবেচনা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে। বিশেষত, ২০২৩ সালে জাপানের বিশেষ দূত আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং চীনের কুনমিংয়ে আরাকান আর্মি ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য বৈঠক হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ভারত তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে একটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার বৈঠক করেছে। তবে বাংলাদেশ কী করবে, তা স্থির করেনি। এখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে বৈঠক করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা আছে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব নীতিমালা অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক।

একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারও আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অথচ তা মূল্যায়ন করে মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য আমরা কোনো বিশেষ ক্ষেত্র স্থাপন করতে পারিনি বা করিনি। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে কোনোভাবেই আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না, বরং আরও মজবুত ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হবে; যা আমরা এখনো গড় তুলতে পারিনি। কারণ এখানে আমাদের চেষ্টার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল এবং এখনো আছে বলে মনে করি।

মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও আরাকান আর্মির সাফল্যের পর বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় থাকাটাও দুর্বল কূটনীতির পরিচায়ক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা কেমন হবে, তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ তথা রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি, মিয়ানমারের দ্বিচারিতা ও চাতুর্যপূর্ণ আচরণ, এশিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলের অতীত ও বর্তমানের ভূমিকার ওপর।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-আমরা শুরু থেকেই মিয়ানমারকে কম গুরুত্ব দিয়ে আসছি। আর তাই মিয়ানমার নিয়ে আমাদের যতটুকু ধারণা বা জ্ঞান থাকা দরকার, তা আমাদের নেই, যে কারণে কোনো কূটনৈতিক আলোচনার টেবিলে আমরা সন্তোষজনক বক্তব্য রাখতে ব্যর্থ হই এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদেরও মন জোগাতে পারি না; এমনকি আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেটি কোনো সময় যথেষ্ট ছিল না। মিয়ানমারের সঙ্গে যে ধরনের দক্ষ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ও সক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, তা কোনো সময় করা হয়নি। তবে বর্তমানে যতটুকু তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি, তা-ও রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের জন্য আলাদা একটি ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে, যা আগে কখনো করা হয়নি।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা যে কোনো দেশের সঙ্গে বৈদেশিক তথা কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও বেশি দক্ষ, কৌশলী ও প্রোঅ্যাক্টিভ বা সক্রিয় হতে হবে। শুধু কোনো সংকট তৈরি হবে আর তখন যোগাযোগ স্থাপন করব-এমন মনোভাব থাকলে তা হবে নিতান্তই বোকামি ও অপরিণামদর্শিতা।

মেজর রেজা উল করিম (অব.) : নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT