সরকার নির্ধারিত নতুন দামে বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ আগের মতো বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের ভোজ্যতেল। অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিতে মিলমালিক পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি থামেনি। ফলে বিশ্ব বাজারে দরপতনের সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। এ অবস্থায় দাম কমানোর সুবিধা ভোক্তা পর্যায়ে কার্যকর করতে কঠোর মনিটরিংয়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
ইতোপূর্বে পামঅয়েলের দাম কমানো হলেও তা খুচরা বাজারে কার্যকর হয়নি। কাগজ-কলমে দাম কমলেও ভোক্তাদের আগের মূল্যে ভোজ্যতেল কিনতে হচ্ছে। একদিকে উৎপাদন বেশি, অন্যদিকে বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে চাহিদা কমে গেছে ভোজ্যতেলের। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের রেকর্ড দরপতন হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় রফতানির সুযোগ দিয়েও কাক্সিক্ষত হারে পামঅয়েল বিক্রি করতে পারছে না। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাসহ সয়াবিন তেল উৎপাদকারী দেশগুলো বাজার হারাচ্ছে।
এ অবস্থায় বিশ্ব বাজারে প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম কমলেও খুচরা বাজার থেকে বেশি মূল্যে ভোক্তাদের তেল কিনতে হচ্ছে। এমনকি সর্বশেষ লিটারে সয়াবিন তেলের দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও ব্যবসায়ীরা আগের মতো বেশি দামে বিক্রি করছেন ভোজ্যতেল। এতে দাম কমানোর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এদিকে, রাজধানীর ঢাকার বেশিরভাগ খুচরা বাজারে নতুন দামে সয়াবিন ও পামঅয়েল পাওয়া যাচ্ছে না। তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে দেশে সয়াবিন তেলের দাম কমছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় কম দামে আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন মিলমালিকরা। এছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভোজ্যতেল আমদানির সুযোগ বহাল রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এতে ব্যবসায়ীরা দুইদিক থেকেই লাভবান হচ্ছেন। একদিকে বিশ্ব বাজারে দরপতন, অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে কয়েক দফায় ভোজ্যতেল ও পামঅয়েলের দাম কমায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দাম কমানোর ঘোষণা শুধু কাগজ-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রকৃতপক্ষে খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেনি।
এদিকে, নতুন দর অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ৭ শতাংশ কমে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অথচ বুধবার পর্যন্ত বাজারে এই তেলের দাম ছিল প্রায় ২০০ টাকা। আর ৯৮০ টাকার পাঁচ লিটারের বোতলের নতুন দাম হবে ৯১০ টাকা। এছাড়া প্রতি লিটার পাম তেলের দাম লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৫২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানদার পাঁচ লিটারের ক্যান ৯৮০-৯৯০ টাকায় বিক্রি করছেন। যদিও সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার ১৬৬-১৭৫, এক লিটারের বোতল ১৮৫-১৯৫, পাঁচ লিটারের বোতল সয়াবিন ৯১০-৯৮০, পামঅয়েল খোলা ১৪৮-১৫৪ এবং পামঅয়েল সুপার ১৬০-১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এদিকে, খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন নতুন দামের তেল মঙ্গলবার পর্যন্ত বাজারে আসেনি। এছাড়া সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তা মিলগেট ও পাইকারি বাজারে কার্যকর হয় না। ফলে খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। খুচরা ব্যবসায়ীদের মতে, ভোজ্যতেলের রাঘব বোয়ালরা কারসাজি করে অতি মুনাফা করছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা চুনোপুঁটি এদের হাতে কিছুই নেই।
কিন্তু অভিযানে সবার আগে বেকায়দায় পড়েন এই খুচরা ব্যবসায়ীরাই। তারা বলছেন, আগে মিলমালিক ও পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ভোজ্যতেলে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে হলে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। উল্লেখ্য, রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিল ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয়। ওই সময় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছিলেন, বিশ্ব বাজারে ধারাবাহিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম কমছে।
এ কারণে দেশেও দাম কমানো হয়েছে। শীঘ্রই আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে আবার দাম সমন্বয় করা হবে। ওই সময় তিনি নতুন দাম কার্যকর করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দাম ঘোষণার দুদিন পরেও আগের মূল্যে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন ও পামঅয়েল।
জানা গেছে, বিশ্ববাজারে দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম কমেছে ৩২ শতাংশ। আর পাম তেলের দাম কমেছে ৪৮ শতাংশ। বিশ্ববাজারের প্রভাবে পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্যতেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম কিছুটা কমলেও বোতলজাত তেলের দাম এখনও সেভাবে কমেনি। সয়াবিনের চেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম।
মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জে গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেল বেচাকেনা হয় ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা লিটার প্রতি প্রায় ১৩৯ টাকায়। গত বুধবার এ দর নেমে আসে ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি ৭১ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে পাম তেলের দর কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করে। আর ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করে হাল্কা পরিশোধিত পাম তেল। এ দুই ধরনের তেলের দামও একইভাবে পড়েছে।
এদিকে আর্ন্তজাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার কারণে দেশে দ্রুত দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। সেই বিবৃতিতে বলা হয়- দেশে ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন দাম বাড়াতে যতটুকু আগ্রহী, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমাতে তেমন আগ্রহী না হবার কারণে ভোজ্যতেলের বাজারে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দীর্ঘদিনেও দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম সমন্বয় হয় না।
এক্ষেত্রে কঠোর বাজার মনিটরিং করা প্রয়োজন। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা তেল দেশের বাজারে আনলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোন সুফল পায়নি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, দেশে তার বিপরীতে বাড়ানো হচ্ছে।
প্রকাশক মোঃ সোহেল রানা ও সম্পাদক: মোঃ মোজাম্মেল হক। ২৭, কমরেড রওসন আলী রোড, বজলুর মোড়, কুষ্টিয়া-৭০০০।
© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | Design and Developed by- DONET IT