মঙ্গলবার ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৬শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পুনঃপেনশন সুযোগ ফাইলবন্দি

প্রকাশিত : ০৮:০৬ পূর্বাহ্ণ, ৭ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার ১১০ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

দুই মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কারণে আটকে গেছে বেবিচক’র শতভাগ পেনশনভোগী দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পুনঃপেনশনের আবেদন। গত ৪ বছর ধরে এ সংক্রান্ত আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বোর্ড সভায় ২০১৯ সালে তাদের পুনঃপেনশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই বিষয়ে একটি অফিস আদেশও জারি করে বেবিচক। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ওই অফিস আদেশ স্থগিত করে দেয়। ফাইলটি নিষ্পত্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ও কারও সঙ্গে আলোচনা না করে পেনশন দেওয়া যাবে না বলে মতামত দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের চিঠিতে জানায়, বেবিচক সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং একটি পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে পরিচালিত হয়। কাজেই এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুনঃপেনশন সুবিধা পাবে না। এরপরই বেবিচকের পুরো প্রক্রিয়া ঝুলে যায়।

পেনশন সুবিধা না পেয়ে গত ৪ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় ৭০ বছর বয়সি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এদের সংখ্যা প্রায় আড়াইশর মতো। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা পুনঃপেনশন পাবেন এ আশায় বেবিচক, মন্ত্রণালয় আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বয়স্ক মানুষগুলো। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনছেন না। তাদের কাতরতায় কারও মনও গলছে না। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে এদের মধ্যে ২৫ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছেন। কেউ কেউ হাসপাতালে ছটফট করছেন। আবেদনকারীদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জনের বেশি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে কারও সার্টিফিকেট আছে কারও নেই। আবেদনকারী এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এমনিতে তারা বড় ধরনের পেনশন বৈষম্যের শিকার। ৮০ বছর বয়সে এখন পেনশন পাচ্ছেন ৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। অথচ তার ভাইয়ের ছেলেও একই গ্রেডে চাকরি করে অবসরে গেছেন ২০১৮ সালের ৩০ জুন। তিনি পেনশন পাচ্ছেন ৩১ হাজার ৪৫৯ টাকা। বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব। তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালের বেতন স্কেল দেওয়ার আগে যারা সর্বোচ্চ স্তরের চাকরি থেকে অবসরে গেছেন, তাদের পেনশন বর্তমান বেতন স্কেলের নবম গ্রেডের সদ্য যোগদানকারী কর্মকর্তার মূল বেতনের চেয়েও কম। এতসব অমানবিক আচরণের পরও বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের সামান্য পেনশন প্রাপ্তির বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকেও পর্যন্ত এরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি এই পুনঃপেনশন পেতে পারেন তাহলে বেবিচক’র কর্মচারীরা পাবেন না কেন?

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর সরকার শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী সরকারি কর্মচারীদের অবসরের ১৫ বছর পার হওয়ার শর্তে পুনঃপেনশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত সরকারি অফিসগুলোর যেখানে পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে সেখানে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০১৮ সালে বেবিচক’র শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী কর্মচারীরা পুনঃপেনশনের জন্য আবেদন করেন। বেবিচকের পরিচালনা পর্ষদ একাধিক বৈঠকের পর তাদের আবেদন মঞ্জুর করে এবং একটি অফিস আদেশ জারি করে। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই অফিস আদেশ জারি করা হয়। এরপর এই আদেশটি বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখান থেকে ২০২০ সালের ৩ মার্চ আদেশটি স্থগিত করার জন্য বেবিচককে চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অনুপ কুমার তালুকদার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, এ ধরনের পেনশন শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। তিনি এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান। এরপর ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পুনঃপেনশনের অফিস অদেশটি স্থগিত করে বেবিচক। মতামতের জন্য ওই বছর ৪ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। অর্থ বিভাগও একই আদেশ বহাল রাখে।

১৯৬০ সালের তদানীন্তন পাকিস্তান সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অধীনে গঠিত পাকিস্তান বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অধিদপ্তর হিসাবে কাজ করে আসছিল। তখন এর কর্মচারীরা পেনশনসহ সব ধরনের সুবিধা পেতেন। সিভিল এভিয়েশনের কার্যক্রমগুলো বিশেষ এবং জরুরি ধরনের কাজ যা ত্বরিত সিদ্ধান্ত ও মাঠপর্যায়ে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে এ কাজগুলো অনেক ক্ষেত্রে করা সম্ভব হয় না। এ কারণে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। ১৯৮৫ সালে গঠিত এই কর্তৃপক্ষে পাকিস্তান থেকে আসা সিভিল এভিয়েশন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের যোগদান করতে বলা হয়। কিন্তু নবগঠিত কর্তৃপক্ষে পেনশন সুবিধা না থাকায় তারা যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে তারা ধর্মঘট করে দেশের সব বিমানবন্দরের অপারেশন বন্ধ করে দেন। ওই আন্দোলনে অনেকে চাকরি হারালেও সরকার ১৯৮৮ সালে এক সম্পূরক অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করে। সে থেকে সিভিল এভিয়েশনে পেনশন সুবিধা চালু আছে। নবগঠিত কর্তৃপক্ষে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী ও এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি থেকে আসা কর্মচারীরাও যাতে পেনশন সুবিধা পান সেজন্য ১৯৯৩ সালে কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য ১৯৮৫ এর অর্ডিন্যান্সের ২৫ ধারা অনুযায়ী পেনশনসংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রবর্তন করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সাল থেকেই কর্তৃপক্ষের সব কর্মচারী এই পেনশন স্কিমের আওতায় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন।

বেবিচক’র এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতামত অনুযায়ী বেবিচক’র কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন। তারা প্রজাতন্ত্রের জন্য কাজ করলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য প্রদত্ত কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না। তিনি পালটা প্রশ্ন রেখে বলেন, দুই মন্ত্রণালয়ের চিঠির ভাষা অনুযায়ী সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। তাহলে এই বিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত কর্মচারীদের চাকরির স্ট্যাটাস কি হবে? যদিও এসব সংস্থায় নিয়োগ নেওয়া-পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনেক শীর্ষ আমলারা বড় বড় জায়গায় তদিবরও করে থাকেন। বর্তমানেও চারজনের বেশি আমলা এই বিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত আছেন। দুই মন্ত্রণালয় তাদের চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছে-এ ধরনের সংস্থার কার্যক্রম একটি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়। তাহলে প্রশ্ন উঠে, বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এবং বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পুনঃপেনশন দেওয়ার অফিস আদেশটি কিভাবে স্থগিত করে মন্ত্রণালয়? ওই কর্মকর্তা বলেন, বেবিচক’র কর্মচারীরা জাতীয় পে- স্কেলের অন্তর্ভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই সংস্থার সব কর্মচারী সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে গণ্য হবেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) একটি অটোনোমাস বডি। এর জন্য ডেলিগেশন অব অথরিটি দেওয়া আছে। এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ১৯৮৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে বেবিচক’র চেয়ারম্যান ও সদস্যকে (অর্থ) কর্মচারীদের পেনশন প্রদানের বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই আদেশ এখনো বলবৎ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র বেবিচক’র কর্মচারীদের চাপে রাখার জন্য এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। একই সঙ্গে এই চক্রটি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে বেবিচক’র কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেবিচক’র এক পরিচালক বলেন, কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদ শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের পুনঃপেনশন প্রদানের আবেদনটি মঞ্জুর করেছিল। এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশও জারি করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে আপাতত সে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT