কিছু পদক্ষেপে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ উন্নত হতে পারে
প্রকাশিত : ০৮:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ সোমবার ১১৭ বার পঠিত
মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার জন্য তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের স্বনির্ভর করে তোলা হলে ক্যাম্পগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, এখানে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
বরাদ্দ হ্রাস : করোনা মহামারি, নতুন নতুন যুদ্ধ ও সময়ের ব্যবধানে রোহিঙ্গা ইস্যু দিনদিন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব হারাচ্ছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার বরাদ্দ প্রতিবছর হ্রাস পাওয়া। আমরা যদি বিগত ৬ বছরের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) হিসাব দেখি, তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রয়োজনের তুলনায় তহবিলের ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ২৪ শতাংশ, ৪০.১ শতাংশ ও ২৮.১ শতাংশ। ২০২২ সালে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বরাদ্দ ৫০.৮ শতাংশ কমে যায়। এভাবে তহবিল হ্রাস পাওয়া এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। একদিকে বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার যৌথ নিবন্ধন কার্যক্রমের তথ্যমতে, যার বর্তমান সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৩। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, চাহিদা তার স্বাভাবিক গতিতে বেড়েই চলেছে আর এর বিপরীতে অর্থ তথা জোগান কমছে। ফলে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যার মাধ্যমে রোহিঙ্গারা কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং তারা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করতে পারবে। ফলে খরচ হ্রাস পাবে, দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং তারা দলীয়ভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে।
ব্লকভিত্তিক ওপেন সার্ভিস সেন্টার : ২০১৮ সাল থেকে এখন অবধি রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন আয় বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অধিকাংশই বেকার অলস সময় কাটাচ্ছে। প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানো যায় এমন প্লাটফর্ম এখনো অনুপস্থিত। এখন উচিত ৪-৫টি ব্লক নিয়ে এমন একটি সার্ভিস সেন্টার তৈরি করা, যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সোলার মেরামত, দর্জি, জাল বোনা, সেলুনের সেবা প্রদান করবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় শাকসবজি উৎপাদন, সাবান তৈরি ইত্যাদি কাজে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ফলে তারা স্বল্পমূল্যে নিজেরা নিজেদের পণ্য ভোগ করতে পারবে।
সম্মিলিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : রোহিঙ্গা শিবিরে ঘন ঘন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে পাহাড়ধস, অতিবৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির ঘটনা বেশি পরিলক্ষিত হয়। চলতি মাসে সপ্তাহের ব্যবধানে দুবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্নভাবে প্রতিটি ক্যাম্পের বিশাল একটি জনসংখ্যা রেসকিউ প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং প্রতিটি ক্যাম্পে তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের একটি তালিকা রয়েছে। এ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে লিংক করে দেওয়া, যেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স তাদের রেসকিউ কাজে সরাসরি ব্যবহার ও দিকনির্দেশনা দিতে পারে। ফলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসার আগের এ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকরা সুশৃঙ্খলভাবে রেসকিউ করতে পারবে।
ক্যাম্প সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি টিম : প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্পে এক বা একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। ক্যাম্প এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের উৎপাত লক্ষ করা যায়। এ গ্রুপগুলো মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার, ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকে। যদিও পুলিশের একটি বিশেষায়িত দল (এপিবিএন) ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে; কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য তা নিতান্তই অপ্রতুল। কিছু ক্যাম্পে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত টহল দলের কথা শোনা যায়, কিন্তু এ দলটি পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়। এ দলটিকে সব ব্লকে বাধ্যতামূলক করা এবং প্রতিটি দল থেকে একজন সদস্য নিয়ে ক্যাম্প সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি টিম প্রণয়ন করা যেতে পারে, যারা প্রতিমাসে এপিবিএনকে একটি প্রতিবেদন দেবে এবং এপিবিএন তাদের কাজে সহযোগিতা করবে। ক্যাম্প ইনচার্জ ব্লকভিত্তিক ওপেন সার্ভিস সেন্টার, সম্মিলিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ক্যাম্প সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি টিমকে ফলোআপ করবেন।
সর্বশেষ বিষয়টি হলো, রোহিঙ্গা শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করা। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তার অর্ধেকের কম পরিমাণ ফান্ড দিয়েও ঠিক তেমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। সুতরাং ফান্ড ক্রাইসিসের এ মুহূর্তে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করতে হবে। অন্যথায় উখিয়া-টেকনাফসহ সমগ্র কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে এবং চাহিদা মেটাতে না পারলে রোহিঙ্গারা হিংস্র হয়ে উঠবে। এমনিতেই স্থানীয়দের অনেকেই কৃষিজমি, নিজের বসতবাড়ি, কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তাদের অধিক দামে কিনতে হয় প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপহরণ ও মাদকের প্রভাব। এখনই যদি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিশাল যুবসমাজকে কোনো কাজে লাগানো না যায়, তাহলে আগামী দিনে পরিস্থিতি কল্পনাতীত ভয়াবহ হতে পারে।
মো. আরিফ উল্লাহ : রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।