সোমবার ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৫শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উৎস চিহ্নিত, প্রতিকারে নেই কার্যকর উদ্যোগ

প্রকাশিত : ০৫:১৪ পূর্বাহ্ণ, ২১ মার্চ ২০২৪ বৃহস্পতিবার ১৬৫ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

নির্মাণকাজের সৃষ্ট ধুলা, ইটভাটা, রান্নার চুলা, যানবাহন ও অন্যান্য ধোঁয়া, শিল্প-কলকারখানারসহ নানাবিধ কারণে দেশে ভয়াবহ বায়ুদূষণ ঘটছে। বায়ুদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত হলেও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে বায়ুদূষণজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে কাশি দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে, নিউমোনিয়া এবং শিশুর শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। আর দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের কারণে স্ট্রোক, ক্যানসার ও হৃদরোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। পাশাপাশি বায়ুদূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ুও কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ায় দেশজুড়ে নানা উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে; এতে বায়ুদূষণ বাড়ছে। সরকার চাইলেও বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধ করা খুবই সহজ হবে না। তবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত উদ্যোগে অনেকাংশে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য সরকারকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে দেশ হিসাবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসাবে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয় শীর্ষ, প্রথমে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। এই প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা তাৎক্ষণিক আইকিউএয়ারের সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় বা সতর্ক করে। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকাসহ সারা দেশের সচেতন মানুষ নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে আতঙ্কবোধ করছেন। চিহ্নিত উৎসগুলো বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি কারণ রয়েছে, তা হলো-নির্মাণকাজের সৃষ্ট ধুলা, ইটভাটার ধোঁয়া ও যানবাহনের ধোঁয়া। এটি ঢাকার জন্য পরিচালিত গবেষণার ফলাফল হলেও সমগ্র দেশের চিত্রও একই। তবে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের আরেক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। ওই গবেষণায় ঢাকা ও আশপাশের এলাকার বায়ুদূষণের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে বাসাবাড়ির রান্নার জ্বালানি, শিল্প-কলকারখানার দূষণ, ইটের ভাটা, কঠিন বর্জ্য পোড়ানো এবং অন্যান্য।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্যমতে, ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মোটরযান দূষণের প্রধান কারণ। এছাড়াও যানবাহনের নিুমানের জ্বালানিও ঢাকার বায়ুদুষণের অন্যতম কারণ বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, পরিবেশ দূষণে বিশ্বে বছরে ৭০ লাখ লোক মারা যায়। এসব মৃত্যুর প্রতি ১০ জনে ১ জন বায়ুদূষণে মারা যায়। বায়ুদূষণের মৃত্যুর প্রধান কারণ স্ট্রোক, ক্যানসার ও হৃদরোগ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর থাকে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে বাতাসের মান বেশি খারাপ থাকে। অন্যান্য বছরের মতো চলতি বছরও বাতাসের মান খারাপ ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার বাতাসের মান বা এয়ার কোয়ালিটি স্কোর (একিউআই) ছিল ২৫০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে। বাতাসের এ মান খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বাংলাদেশে শীতকালে ঢাকাসহ সারা দেশের বাতাসের মান বেশি খারাপ থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে কিছুটা উন্নতি লাভ করে। বছরের জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঢাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এসব কারণে তখন ঢাকার বাতাস অনেকটা নির্মল থাকে। সারা দেশের বাতাসের মান খারাপ থাকলেও সরকার ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তাতেও কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনছে না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর ঢাকায় গড়ে ৫০০টি নতুন ভবন তৈরি হয়। এসব ভবনের নির্মাতাদের অধিকাংশই ধুলার উৎস প্রতিরোধ না করেই ভবন নির্মাণ করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে বেখেয়াল থাকে। প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার সড়কে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলে। সেসব থেকেও প্রচুর ধুলা তৈরি হয়। চলতি মৌসুমে সিটি করপোরেশন এলাকায় নর্দমা, ফুটপাত, সড়ক, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য ২০০ কিলোমিটারের বেশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব সড়কের উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। এজন্য তাদের ব্যাপারে সিটি করপোরেশনও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকাসহ সারা দেশে ইটভাটার ছড়াছড়ি। এসব ইটভাটার ধোঁয়া ঢাকার বাতাসকে দূষিত করছে। সরকার উন্নয়ন ও নির্মাণকাজে ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা দিলেও তাতে তেমন সফলতা মেলেনি। ২০২৪ সালের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে শতভাগ ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। স্বল্প পরিমাণ উন্নয়ন ও নির্মাণকাজে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার শুরু করেছে। তবে আশার কথা, বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি কংক্রিট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সহায়তা করার পরামর্শ দায়িত্বপ্রাপ্তদের।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : জানতে চাইলে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত। তবে প্রতিরোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এতে নানাবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। কমে যাচ্ছে দেশের মানুষের গড় আয়ুও। ইটভাটা, নির্মাণ কাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়াসহ বায়ুদূষণ সৃষ্টির সব ধরনের উৎস বন্ধে সরকারকে সমানতালে ভূমিকা পালন করতে হবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, দেশের মানুষের আয়-রোজগার বাড়ছে। এতে নানামুখী কার্যক্রম হচ্ছে দেশে। বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে মানুষ। তবে কাজগুলো অপরিকল্পিত ও যত্রতত্র যেনতেনভাবে করা হচ্ছে। এ কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, সরকার যদি পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজগুলো নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে অনেকাংশে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদিও এ কাজগুলো অত্যন্ত কঠিন। সরকার চাইলেই করে ফেলতে পারবে না। তবে কার্যকর উদ্যোগ নিলে সময়ের ব্যবধানে তা করা সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট’ (সিসিএইচপিইউ)-এর সমন্বয়কারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল কবির বলেন, বায়ুদূষণের কারণে নানাবিধ রোগব্যাধি হচ্ছে মানুষের। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য-কাঁশি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বাড়ছে। আর শিল্পকারখানা বা নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ত্বকের বিভিন্ন অসুখ হচ্ছে। এছাড়া বায়ুদূষণজনিত পরিবেশে দীর্ঘদিন কাটালে তারা স্ট্রোক, ক্যানসার ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পাশাপাশি বিকলাঙ্গ শিশুরও জন্ম হচ্ছে। বায়ুর মান উন্নয়নে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণসহ বায়ুদূষণের সব উৎস বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, বায়ুদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত। এর আলোকে দূষণ বন্ধে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এ কাজটি শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয় এককভাবে করতে পারবে না। সব মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি পর্যায় থেকেও দূষণ প্রতিরোধে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। ইটভাটা বন্ধের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় ঘোষণা করেছেন তার মেয়াদকালের প্রথম ৩ মাসের মধ্যে ৫০০টি ইটের ভাটা বন্ধ করা হবে। এছাড়া অন্যান্য বায়ুদূষণের উৎস বন্ধেও তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

পরিবেশ, বন ও জলাবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বায়ুদূষণ ঘটছে, সেটা সরকার স্বীকার করছে। এর মানে আমরা এ সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। যেসব কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, সেসব উৎস বন্ধে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT