শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৩ কারণে হেরে গেলেন সাক্কু

প্রকাশিত : ০৫:২৯ অপরাহ্ণ, ১৭ জুন ২০২২ শুক্রবার ১৮৬ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

বহুল আলোচিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়িয়েছে। টান টান উত্তেজনার এই নির্বাচনে সাবেক দুবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু হেরে গেছেন। তাকে হ্যাটট্রিক জয়লাভ করতে দিলেন না নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরে নগরপিতার চেয়ার ছাড়তে হচ্ছে সাক্কুকে। সাক্কু ফল প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সেটি কতটুকু কাজে দেবে সেটিও ভাববার বিষয়।

বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পরাজয়ের কারণগুলো নিয়ে এখন নগরজুড়ে আলোচনা চলছে। টানা দুই মেয়াদের এ মেয়রের পরাজয়ে নেপথ্যে কোন কোন জিনিস কাজ করছে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, সাক্কু এমন ফল হবে ঘূর্ণাক্ষরেও প্রত্যাশা করেননি। কুমিল্লার রাজনীতিতে ভোটব্যাংকের মালিক এই নেতা ভোটের আগমুহূর্তে রাজনৈতিক মেরুকরণ পাল্টে এমন হবে সেটি ভাবতেও পারেননি। দীর্ঘদিন যার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করেছেন, সেই বাহাউদ্দিন বাহার এমপি তাকে হারাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামবেন সেটিও ছিল সাক্কুর হিসাবের বাইরে। এর পরও নিজস্ব ভোটব্যাংক ও উন্নয়নের কারণে এ যাত্রায়ও নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে পারবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সাক্কুর। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যে দলের রাজনীতি করেছেন সেই দলটির বিরোধী পক্ষের ‘ষড়যন্ত্রে’ শেষ পর্যন্ত হারতে হলো সাক্কুকে। মেয়র পদে লড়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নিজামুদ্দিন কায়সার প্রায় ৩০ হাজার ভোট না কাটলে ‘এত কিছুর পরও’ সাক্কুর জয় ঠেকানো যেত না বলে মত স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

সাক্কুর হেরে যাওয়ার পেছনে মোটাদাগে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তারা। প্রথমত বিএনপির সমর্থন না পাওয়া। দ্বিতীয়ত স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহারের চরম বিরোধিতা। তৃতীয়ত বিএনপির একটি অংশ কায়সারকে সমর্থন দেওয়া।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এটি ছিল তৃতীয় নির্বাচন। আগের দুবার ২০১২ ও ২০১৭ সালে সাক্কু মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে। ২০১২ সালে কুসিকের প্রথম নির্বাচনে মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ৭২ জন ভোট দিয়েছিলেন। ভোটের হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৬ শতাংশ। ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মনিরুল হক সাক্কু। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খান পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ২৯ হাজার ১০৬।

২০১৭ সালের নির্বাচনে কুসিকে ভোটার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। ভোট পড়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৬৯০। ভোটের হার ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিএনপির প্রার্থী সাক্কু ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানার নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। অর্থাৎ ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ছিল। তবুও সীমা হেরেছিল বিএনপির প্রার্থীর কাছে। সেময় পরাজয়ের কারণ হিসাবে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে সামনে আনা হয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং সাবেক মেয়র সাক্কু। এবার ভোটার ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০। ভোট পড়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৭৪৫টি। ভোট পড়েছে ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। আর সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন রিফাত। তবে ভোটের হার কমলেও ভোটার সংখ্যা বাড়ায় এবারের নির্বাচনে গত নির্বাচনের চেয়ে প্রায় দুই হাজার ভোটার বেশি ভোট দিয়েছে। গত নির্বাচনে সীমা পরাজিত হলেও এবারের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার ৫৫৩ ভোট বেশি পেয়েছিল নৌকা।

কুমিল্লার সাধারণ ভোটার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাক্কুর পরাজয়ের পেছনে স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী নিজাম উদ্দিনের প্রায় ৩০ হাজার ভোটপ্রাপ্তি একটি বড় কারণ। দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সেই ভোট দুজনের বাক্সে ভাগ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোট এভাবে ভাগ না হলে অধিকাংশ ভোট যেত সাক্কুর বাক্সে। সে ক্ষেত্রে তার পাওয়া ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোটের সঙ্গে আরও ভোট যুক্ত হতো। মেয়র পদে বেসরকারিভাবে জয়ী আরফানুল হক ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়েছেন।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কুমিল্লা জেলার সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত মনিরুলের পরাজয় হয়। মনিরুল যে ভোট পেয়েছেন, তার অধিকাংশ সাধারণ ভোটারের ভোট। আর নিজাম উদ্দিনের বাক্সে গেছে বিএনপির অধিকাংশ ভোট।

আগের দুটি নির্বাচনে সাক্কুর প্রতি কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের ‘নীরব সমর্থন’ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। তৃতীয় বারের নির্বাচনে এসে জয়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করে।

আফজল পরিবারের বাইরে গিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেয় বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠ জন হিসাবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাতকে। শুরুতে রিফাত ছাড়াও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এর মধ্যে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা এবং ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরানও ছিলেন। পরে সীমা মনোনয়ন ফরম জমা না দিলেও প্রার্থী হয়েছিলেন ইমরান। যদি পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তবে অভিযোগ ছিল এই মনোনয়ন প্রত্যাশী এসব নেতা এবং আফজল পরিবার রিফাতের পক্ষে সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিল না। তবে এবার বাহাউদ্দিনের পুরো ‘আশীর্বাদ’ পেয়েছিলেন রিফাত। নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনা হলেও নির্বাচনের সময় এলাকা ছাড়েননি এই সংসদ সদস্য। তিনি ও তার পক্ষের অনুসসারীরা সবাই রিফাতের পক্ষে মাঠে ছিল।

এদিকে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন অনুকূলে রেখেছেন অপর স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। যার ফলে ভোটের মাঠে অনেকটাই দলীয় কর্মী শূন্য ছিলেন সাক্কু।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে সাক্কুর পরাজয়ের বড় কারণ হচ্ছে দলীয় কোন্দল। একই দলের একাধিক প্রার্থী। বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী জোটের সমর্থন না পাওয়া। দীর্ঘ ১০ বছর মেয়রের চেয়ারে বসে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা। নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলার অভিযোগ। সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত।

এ ছাড়া বিগত দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা। নগরীর প্রধান সমস্যা যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা। টেকসই উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সবশেষ সরকার দলের মিত্রদের সমর্থন না পাওয়া। সাক্কুর এবারের পরাজয়ের নেপথ্যে এসব বিষয় এখন আলোচিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা আরও বলছে, বিগত দুটি নির্বাচনে সাক্কুর জয়ের নেপথ্যে ছিল সরকারদলীয় মিত্রদের ভূমিকা। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাক্কু যেভাবে সহজ জয় লুফে নিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত সেভাবে বিএনপির দলীয় কোন্দলকে কাজে লাগাতে পারেনি।

এদিকে দল এবং জোটের প্রত্যক্ষ এবং সরকার দলের মিত্রদের পরোক্ষ সহযোগিতা না পেলেও সাক্কু তুমুল লড়াই করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। তিনি তার ব্যক্তিগত ভোটব্যাংক কাজে লাগিয়েই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে ভোটের লড়াই করেছেন।

কুমিল্লা বিএনপির রাজনীতিতে দলের কুমিল্লা দক্ষিণ শাখার আহ্বায়ক আমিন উর রশীদ ইয়াছিনের প্রভাব রয়েছে। তার সঙ্গে সাক্কুর দ্বন্দ্ব পুরোনো। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন যে এলাকায় ডসেই আসনে ইয়াছিন বাহারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০১৮ সালে ১ লাখ ২ হাজার ৩৫০ ভোট পান। ওই নির্বাচনে ২৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আর অংশ নেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকার পুরোটাই এই সংসদীয় এলাকার আওতায়। আর এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কায়সার হলেন এই ইয়াছিনের শ্যালক। তাই বিএনপির এই নেতার অনুসারী ও নিজস্ব ভোটের পুরোটাই পেয়েছেন কায়সার।

কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকার বিএনপির রাজনীতিতে তার প্রভাব আছে। এটিও কাজ করেছে কায়সারের পক্ষে। কুমিল্লার বৃহৎ শিল্প গ্রুপ লালমাই গ্রুপের মালিক হলেন ইয়াছিন। তার শিল্পকারখানায় কয়েক হাজার কর্মী কাজ করেন। এসব শিল্পকারখানার আশপাশের এলাকাতেও বেশি ভোট পেয়েছেন কায়সার।

এসব বিষয়ে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমি হারিনি, আমাকে পরিকল্পিতভাবে পরাজয় দেখানো হয়েছে, উপর মহলের নির্দেশে আমার জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার কারণে আমার রেজাল্ট ছিনতাই হয়েছে। এজন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাই দায়ী। সাক্কু বলেন, দলের ভোট ভাগ হলেও কুমিল্লার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে, আমি জয়ী হয়েছি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বের কারণে ফল ধরে রাখতে পারিনি, আমি আইনি লড়াই করব। সাক্কু বলেন, আমার পরাজয়ের নেপথ্যের বিশ্লেষণগুলো সঠিক নয়।

বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তাক মিয়া বলেন, আমরা দলীয়ভাবে এ নির্বাচন বর্জন করেছি, দুজন নেতা এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের পক্ষে কাজ না করার জন্য নেতাকর্মীদের আগে থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমার দল বিশ্বাস করে এই সরকার এবং কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না, তাই আমরা এসব নির্বাচন বর্জন করে আসছি।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT