রবিবার ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২০ সূচকের ১৭টি রেডজোনে

প্রকাশিত : ০৬:২৭ পূর্বাহ্ণ, ৭ নভেম্বর ২০২২ সোমবার ৮৬ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

বিশটি সূচকের মধ্যে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৭টিতেই বাংলাদেশের অবস্থান রেডজোনে (খারাপ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের’ (এমসিসি) মূল্যায়নে উঠে এসেছে এমন চিত্র। গত বছরের (২০২২) তুলনায় এবার একটি সূচকের অবনতি হয়েছে। তখন রেডজোনে ছিল ১৬টি। প্রতিবছর ‘রেড’ বা লাল এবং ‘গ্রিন’ বা সবুজ (ভালো) সংকেত দিয়ে সূচকের মান প্রকাশ করা হয়। তৃতীয় পক্ষ (থার্ড পার্টি) দিয়ে এ মূল্যায়ন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি ২০২৩ সালের জন্য বাংলাদেশের মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে এমসিসি। সেখানে ‘বাংলাদেশ স্কোরকার্ড’-এ উল্লেখ করা হয়, মাত্র তিনটি সূচক রয়েছে গ্রিন বা সবুজ জোনে। গত ১৯ বছরের মধ্যে এই প্রথম এত বেশিসংখ্যক লাল সূচকভুক্ত হলো বাংলাদেশ। লাল সূচক বেশি পাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) মোটা অঙ্কের অনুদান পাওয়া ফের অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। স্কোরকার্ডের উন্নতির ভিত্তিতে সাধারণত কোনো দেশকে এই ফান্ডে যুক্ত করা হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর চেষ্টা করেও এই ফান্ডে যুক্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। এবারও হলো না। এটাকে ব্যর্থতা হিসাবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু স্কোর উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই ইআরডির।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান রোববার বলেন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি কয়েকদিন আগে দায়িত্বে এসেছি। তাই বুঝতেই পারছেন। তবে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখব কী করা যায়।

তবে ইআরডি’র একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্কোরের উন্নতি করাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এমসিসি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা আমাদের তথ্য গ্রহণ করতে চায় না। ফলে এক্ষেত্রে উন্নতি করাটা প্রায় দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে আমরা এবার স্কোর উন্নতিতে কোনো প্রচেষ্টা চালাইনি।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ যে ১৭টি সূচকে রেডজোনে আছে, সেগুলো হচ্ছে-কন্ট্রোল অব করাপশন (দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ), রাজনৈতিক অধিকার, সরকারের কার্যকারিতা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, বাণিজ্য নীতিমালা, ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (তথ্যের স্বাধীনতা), ঋণ প্রাপ্তির সহজলভ্যতা, অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা। আরও আছে বেসামরিক লোকের স্বাধীনতা, আইনের কার্যকারিতা, ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্বনীতি) এবং শিশুস্বাস্থ্য।

এছাড়া সবুজ তালিকায় থাকা সূচকগুলো হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, টিকা দেওয়ার হার এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীদের অন্তর্ভুক্তির হার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রোববার বলেন, এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির যে অবস্থা সেটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’। কিন্তু কীভাবে এটা বাস্তবায়ন হবে সে নিয়ে কোনো নীতিমালা বা কর্মপরিকল্পনা করা হয়নি। ফলে অদ্যাবধি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। মাঝে মাঝে চুনোপুঁটিদের ধরা হলেও রুই-কাতলাদের কখনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। তাই দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা একই জায়গায় আছে। এই প্রতিবেদন দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সূচক রেডজোনভুক্ত হলো ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে। গত ১১ বছরের চিত্র হচ্ছে-২০২২ সালের প্রতিবেদনে রেডজোনে ছিল ১৬টি সূচক। এছাড়া ২০২১ প্রতিবেদনে রেডজোনে ছিল ১৩টি সূচক। ২০২০ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ১১টি, ২০১৮ সালে ৭টি এবং ২০১৭ সালে ছিল ১০টি সূচক। এর আগে ২০১৬, ২০১৫ এবং ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে ছিল ৯টি করে সূচক। এছাড়া ২০১৩ ও ২০১২ সালের প্রতিবেদনে রেডজোনে ছিল ১০টি করে সূচক।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মার্কিন এ প্রতিবেদনে যে অবনতিশীল অবস্থা ফুটে উঠেছে তার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। দেশে কর্মসংস্থানে যে দুর্বল অবস্থা সেটি স্পষ্ট। করোনা মহামারির আগে থেকেই পোশাক খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমতে থাকে। করোনাকালীন সেটি প্রকট আকার দেখা দেয়। ২০২১ সালে কিছুটা পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাত যে বেহাল, তা করোনার সময়ে প্রকাশ পেয়েছিল। এছাড়া ওই সময় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলেনি। পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে নানা কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের তো সে ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থা কোথায় নিয়ে যায় তা সহজেই অনুমেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের-সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান একটা জটিল পরিস্থিতি চলছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক সংকট। এই পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকা, সুশাসনের সংকট, দুর্নীতি রোধ ও জবাবদিহিতার ব্যাপক ঘাটতি আছে। এ কারণে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ চিহ্নিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই উন্নত না হয়ে বরং দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের অবস্থা ফুটো কলসিতে পানি ঢালার মতো হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

ইআরডি সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে। এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া। এমসিএফ-এর আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অঙ্কের সহায়তার দেশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অঙ্কের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেওয়া হয়। এই ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতিবছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। কোনো দেশকে মূল্যায়নের জন্য প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন নির্দেশকসহ মোট ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। ওই বছরই প্রথমবারের মতো মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেন। ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধিও। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। এর মধ্যে এমসিএফ-এর বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে টেকনিক্যাল টিম পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হলেও চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT