শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজে বিশৃঙ্খলা
প্রকাশিত : ০৭:০০ পূর্বাহ্ণ, ১৯ নভেম্বর ২০২২ শনিবার ৬৬ বার পঠিত
ঢাকার গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন এবং কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনা’সংক্রান্ত কমিটি। পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি রুটে প্রায় ২০০ বাস চালু করা হয়েছে। কিন্তু শৃঙ্খলা ফেরানোর এ কাজে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
রুট রেশনালাইজেশন পদ্ধতির কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পেতে যে যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা জানলেও সমাধানের বিষয়ে নির্বিকার। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ পদ্ধতির ওপর নগরবাসীর আস্থা হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভালো এই উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় ঢাকায় চালু করা বাসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঢাকা নগর পরিবহণ।’ ২১, ২২ ও ২৬ নম্বর রুটে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়। কিন্তু এসব রুটে রুট পারমিটবিহীন প্রচুর বাস ও অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। এর মধ্যে ২১ নম্বর রুটের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ঢাকা জেলার নিবন্ধনপ্রাপ্ত শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রী পরিবহণ করছে। আর ২২ নম্বর রুটে গ্লোরি পরিবহণ, মৌমিতা পরিবহণ, গ্রিন বাংলা, স্বাধীন পরিবহণ, অভিনন্দন পরিবহণ, পরিস্থান পরিবহণ ও প্রজাপতি পরিবহণ চলাচল করছে। পাশাপাশি মাইক্রোবাস কেটে অবৈধভাবে বানানো লেগুনা এবং রুট পারমিটবিহীন লেগুনা কাজলা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত চলাচল করছে। ২৬ নম্বর রুটের কদমতলী অংশে আনন্দ পরিবহণ, বোরাক পরিবহণ, আলদি পরিবহণ, রাইদা পরিবহণ চলাচল করছে। একই রুটের ঘাটারচর অংশে মালঞ্চ পরিবহণ, পরিস্থান পরিবহণ, মিডলাইন পরিবহণ এবং ১৩ নম্বর বাস চলাচল করছে।
আরও জানা যায়, ১৯ অক্টোবর ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন অভি মোটর্সের স্বত্বাধিকারী মো. কফিল উদ্দিন। এতে বলা হয়েছে, ১৩ অক্টোবর থেকে অভি মোটর্স বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় ২২ নম্বর রুটে বাস পরিচালনা করছে। ওই রুটে রুট পারমিটবিহীন প্রচুর বাস ও অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। এর ফলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা পরিবহণগুলোর মধ্যে রয়েছে-মাইক্রোবাস কাটা লেগুনা, গ্লোরি পরিবহণ, আশিয়ান পরিবহণ এবং গ্রিন বাংলা পরিবহণ। এছাড়া ৩ রুটে চালু করা ‘ঢাকা নগর পরিবহণ’র বাসগুলো যেভাবে চলাচল করার কথা তারও ব্যত্যয় করছে। সেসব ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ২১ নম্বর রুটের যাত্রা শুরু হয় ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে। এই রুট কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর-জিগাতলা-প্রেসক্লাব-মতিঝিল-যাত্রাবাড়ী হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত। ১৩ অক্টোবর চালু হয়েছে ২২ ও ২৬ নম্বর রুট। ২২ নম্বর রুট ঘাটারচর-ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর টাউন হল-আগাদগেট-ফার্মগেট-কাওরান বাজার-শাহবাগ-কাকরাইল-ফকিরাপুল-মতিঝিল-টিকাটুলি-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কোনাবাড়ী হয়ে ডেমরা স্টাফকোয়ার্টার পর্যন্ত। আর ২৬ নম্বর রুট ঘাটারচর-ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর-টাউন হল-আগাদগেট-কলাবাগান-সায়েন্সল্যাব-নিউমার্কেট-আজিমপুর-পলাশী-চানখাঁরপুল-ফ্লাইওভার হয়ে পোস্তগোলা কদমতলী পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। ৩৮৬টি অনুমোদিত রুটে বিশৃঙ্খলভাবে এসব বাস চলাচল করছে। বাস কোম্পানিগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় গণপরিবহণগুলো মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্য দুর্ঘটনা ও হতাহত নগরজীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। সেখান থেকে পরিত্রাণ দিতে ২০১৫ সালে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ইতোমধ্যে সাত বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও মাত্র ৩টি রুটে পরীক্ষামূলকভাবে বাস চলাচল শুরু করতে পেরেছে দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১৫ সালের শেষের দিকে তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় সংশ্লিষ্টরা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ১৬টি সুপারিশ করেন। সেসব সুপারিশ গ্রহণ করে পরিবহণ মালিকরা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। বিশ্বের উন্নত দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাপনার আদলে রাজধানী ঢাকায়ও ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানিভিত্তিক পরিবহণ ব্যবস্থাপনা’ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ঢাকার ৩৮৬টি রুট নেমে আসবে ৪২টি রুটে। আর ৩০০ বাস কোম্পানিকে নামিয়ে আনা হবে ২২টিতে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রথম নির্বাচিত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর কিছুদিন এই উদ্যোগ থমকে ছিল।
এরপর ২০১৮ সালের জুলাই-আগস্টে নিরাপদ সড়ক দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কয়েকটি সভা করে ঢাকায় বিআরটিসির বাস চালু করে। তবে এ উদ্যোগ সফলতা আনতে পারেনি।
পরে ঢাকার বর্তমান দুই মেয়রের নেতৃত্বে ঢাকা নগর পরিবহণের মাধ্যমে ঢাকার গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট বাস রুটগুলোতে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত ও বাস চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ৭০টি বাস স্টপেজ, ৪টি বাস ডিপো-টার্মিনাল এবং ১টি লে-ওভার টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে।
গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঢাকার বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তারা এই প্রক্রিয়াটি না বুঝেই কাজ শুরু করেছেন। এই কাজের বিজ্ঞানভিত্তিক যে পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার, তারা সেটা করছে না। ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পরীক্ষামূলক রুটের কার্যক্রম ভুলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে সফলতা মিলবে না।
এ প্রসঙ্গে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনা’ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য এবং গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালাহ উদ্দিন বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের কাজ যেভাবে করা দরকার, সেভাবে করা হচ্ছে না। ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত। বিষয়গুলো সর্বশেষ সভায়ও আলোচনা হয়েছে। এই কাজের দায়িত্ব নেওয়া ঢাকার দুই মেয়র এ ব্যাপারে আন্তরিক। কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং; আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে পাইলটিং কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।