মোহাম্মদপুরে মার্কেটে আগুন চালে পোড়া গন্ধ, ৩ হাজারের বস্তা বিক্রি ৩০০ টাকায়
প্রকাশিত : ০৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার ৮৮ বার পঠিত
চারদিকে পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন পণ্যের স্তূপ। এর পাশেই ১০ বস্তা চাল। প্রতিটি বস্তার মুখ খোলা। বস্তার সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ ‘চালের বস্তা ৩০০, চালের বস্তা ৩০০’ বলে হাঁক ছাড়ছেন। ৩০০ টাকা বস্তা শুনে প্রথমে অবাকই হচ্ছেন অনেকে। ভিড় করছেন বস্তার সামনে। হাতের মুঠোয় চাল তুলে নাকে নেওয়ার পর ফিরে যাচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। কারণ চালে শুধু পোড়া গন্ধই নয়, ফুলেও গেছে। এই দৃশ্য গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের।
চাল বিক্রেতা বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল– তাঁর নাম দুলাল মোল্লা। পুড়ে যাওয়া মার্কেটে তাঁর ছেলে মনির মোল্লার চালের পাইকারি দোকান ছিল। ২৫ ও ৫০ কেজির ৬০০ বস্তা চাল ছিল দোকানে। সর্বনাশা আগুনে বেশির ভাগ বস্তা পুড়ে গেছে ও পানিতে নষ্ট হয়েছে। সেখান থেকে বাছাই করে অন্য বস্তায় ভরে কিছু চাল বিক্রি করছেন তিনি। তাঁর ভাষ্য– পোড়া ও ভেজা চাল বিক্রি করে যে কয় টাকা পাওয়া যাবে, এখন সেটাই কাজে আসবে। তবে চাল একটু গন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৩ হাজার টাকা বস্তার চাল ৩০০ টাকায়ও কেউ কিনতে চাচ্ছে না।
দুলাল মোল্লার মতো অনেক দোকানি কিংবা কর্মচারী পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে বের করে সাবান, আটার প্যাকেট, লবণ, ভিমবারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তিন ভাগের এক ভাগ দামে বিক্রি করছেন সেখানে। তাদের ভাষ্য– এসব পণ্য তো ফেলেই দিতে হবে, যেগুলো একটু ভালো আছে সেগুলো বিক্রি করছেন কম দামে।
গত বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজারে আগুন লাগে। কৃষি মার্কেটের পাশে অবস্থিত বলে অনেকের কাছে এটি কৃষি মার্কেট হিসেবে পরিচিত। আগুন লাগার প্রায় ২৮ ঘণ্টা পর গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় আনুষ্ঠানিকভাবে আগুন নেভানোর কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। আগুন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ১৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে তদন্ত কমিটিকে।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিক, কর্মচারী ও ভাড়াটিয়া দোকানির তালিকা তৈরি করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এতে ২৪৮ দোকানি ও ৪৬৩ জন কর্মচারীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান। এ ছাড়া দুপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করেন।
গতকাল সকাল থেকেই মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতি পুড়ে যাওয়া দোকানের তালিকা তৈরি করে। তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকা ব্যবসায়ী সমিতির অফিস সহকারী আতিয়ার রহমান ডন জানান, সিটি করপোরেশনের এই মার্কেটে স্বর্ণালংকার, পোশাক, জুতা, হাঁড়িপাতিল, মুদি দোকান থেকে শুরু করে সব ধরনের দোকান রয়েছে। স্থায়ী দোকান সংখ্যা ৩১৭টি। আর অস্থায়ী (ফাঁকা স্থানে বসানো) দোকান ১২৭টি। এর মধ্যে মাছ বাজারের ৭৪টি দোকান একবারে অক্ষত রয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তালিকায় ২০৭টি স্থায়ী দোকান পুড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আর অস্থায়ী দোকান পুড়েছে ১২০টি।
তালিকার বাইরে আরও কয়েকটি দোকান পুড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুলোর মালিক এখনও তালিকায় নাম ওঠাননি। এই মার্কেটে ১৪ জন নিরাপত্তাকর্মী দিনে ও রাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। তবে বুধবার রাতে দায়িত্বে ছিলেন ছয়জন।
অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। কেউ পোড়া দোকানের সামনে বসে চোখের পানি ফেলছেন, কেউ পোড়া পণ্য সরিয়ে অক্ষত কিছু পাওয়া যায় কিনা খুঁজছেন। আবার কেউ পোড়া-নষ্ট জিনিসপত্র বস্তায় ভরে বাইরে ফেলছেন। কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
মার্কেটটির ‘গ’ ব্লকে ৫৮ নম্বর জুতার দোকানের সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ ব্যবসায়ী মনির আহমেদ। তিনি জানান, তাঁর চারটি জুতার দোকান। দেড় কোটি টাকার জুতার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক টাকার পণ্যও অক্ষত নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তিনি এবং তাঁর বড় ছেলে মাসুদ আলম এই ব্যবসা দেখভাল করতেন। জুতার ব্যবসা ছাড়া তাদের আর কোনো আয়ের উৎস নেই। এখন কীভাবে সংসার চালাবেন ও পরবর্তী ব্যবসা শুরু করবেন– তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
মনির আহমেদ বলেন, ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই মার্কেটটি চালু হয়। শুরু থেকেই জুতার ব্যবসা করছেন তিনি।
৫৩ নম্বর দোকানে ছিটকাপড় বিক্রি করা হতো। দোকান মালিক মফিজুল হক দোকানের সামনে টুলের ওপর বসে কাঁদছিলেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাঁর এক স্বজন। মফিজুল বলেন, বুধবার ছিটকাপড় বিক্রির ৫৫ হাজার টাকা ক্যাশ বাক্সে রেখে গিয়েছিলেন। দেড় কোটি টাকার পণ্যের পাশাপাশি টাকাও পুড়ে ছাই হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি এখন কী করে জীবন চালাব। হাতে একটি টাকাও নেই। ব্যবসা দাঁড় করাব কীভাবে।’
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, এই অগ্নিকাণ্ড নাশকতা হতে পারে। এই স্থানে বহুতল মার্কেট করার উদ্দেশ্যে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে। অবশ্য এটি দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছেন মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলিমউল্লাহ সলু। তিনি বলেন, মার্কেটের কিছু দোকান বাদে প্রায় সব পুড়ে গেছে। পোড়া জিনিসপত্র সরিয়ে দোকান মেরামত করতে ৮ থেকে ১০ দিন সময়ের ব্যাপার। এ সময়ে মার্কেটের সামনের রাস্তায় অস্থায়ী দোকান বসানোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মার্কেট নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা কখনও ছিল না, এখনও নেই। এই অগ্নিকাণ্ড কোনো নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা। মার্কেটের সামনের হক কনফেকশনারি নামের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
তবে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার বলেন, কীভাবে আগুন লেগেছে এখনও বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে তা বলা সম্ভব নয়।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।