নিজস্ব আ.লীগ গড়ছেন এমপি রিমন
প্রকাশিত : ০৮:০৫ পূর্বাহ্ণ, ৬ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার ৯৪ বার পঠিত
নিজের মতো করে আওয়ামী লীগ বানাচ্ছেন এমপি রিমন। এমনই অভিযোগ তার নির্বাচনি এলাকা বরগুনা-২ (বামনা-বেতাগী-বরগুনা)-এর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। পরপর তিনবার এমপি থাকলেও দলের ত্যাগী-পরীক্ষিত মূলধারাকে নিজের দিকে টানতে পারেননি তিনি। যে কারণে নিজস্ব বলয় তৈরি করতে আলাদা আওয়ামী লীগ গড়ার উদ্যোগ। এমপি রিমন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পদ-পদবি ধরে রেখে যারা দলকে কুক্ষিগত করতে চায়, তারাই এসব কথা ছড়াচ্ছে বলে পালটা অভিযোগ তার। এমপি রিমনকে ঘিরে আওয়ামী লীগে চলমান এই বিভক্তির পাশাপাশি এখানকার বিএনপিও ভালো নেই। সাংগঠনিক শক্তি অনেকটাই তলানিতে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দলটি। সাবেক এমপি নূরুল ইসলাম মনির আনাগোনায় প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে দলে। তবে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
রাজাকারপুত্র রিমনকে আজও মেনে নেননি নেতাকর্মীরা : পুরো নাম শওকত হাচানুর রহমান রিমন। একসময় ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদ এবং পাথরঘাটা উপজেলার চেয়ারম্যান। ২০০৪ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। শুরু থেকেই দলে তার যোগদানের বিষয়টি মানতে পারেননি বরগুনা-২ আসনের আওয়ামী লীগ নেতারা। কারণ, তার বাবা বরগুনা জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি খলিলুর রহমান ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের লোক আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছেন তিনি। বহু মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগারদের বাড়িঘর জালিয়েছেন নিজ হাতে। যে কারণে ২০১৩ সালে প্রথম যখন উপনির্বাচনে মনোনয়ন পান রিমন, তখনই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন পান তিনি। এই দুবারও তার মনোনয়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয় সেখানে। যদিও সেই বিক্ষোভের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্র। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নানাভাবে বিতর্কে জড়ান রিমন। কথায় কথায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর, বিরোধপূর্ণ জমি কিনে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মামলায় জড়িয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের ঘটনায় বারবার সংবাদের শিরোনাম হন তিনি। সালিশি বৈঠকের নামে নারীদের মারধর এমনকি নারীর মাথায় মানব আবর্জনা ঢালার ঘটনাও ঘটান এই আওয়ামী লীগ নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলের এমপি হয়েও বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পাথরঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল খালেক বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম কি একজন রাজাকারপুত্র আওয়ামী লীগের এমপি হবে সেটা দেখার জন্য? আমাদের হৃদয়ে ১০ বছর ধরে রক্তক্ষরণ। নেত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে এতদিন চুপ ছিলাম। রিমনকে নয়, ভোট দিয়েছি নৌকায়। কিন্তু এবার আর তা হবে না। তাকে আবার মনোনয়ন দিলে ব্যাপক বিক্ষোভ হবে।’
পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মনি মন্ডল বলেন, ‘আমার বিশ্বাস বাবা খলিল রাজাকারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার এজেন্ডা নিয়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন রিমন। আওয়ামী লীগের লোকজন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে বিনাশ করার কাজ করছেন তিনি। তাকে যদি আবারও দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
নিজস্ব আওয়ামী লীগ গড়ার অভিযোগ : বামনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ বলেন, ‘গত ১০ বছরে এমপি রিমন আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছে। এখানে এখন চলছে রিমন লীগ তৈরির কার্যক্রম। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সপক্ষে যারা আছেন, তাদের প্রতিই তার সব বিদ্বেষ। সে তার রাজাকার বাবার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাকে যদি আবার মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গণপদত্যাগ করবে।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জমাদ্দার বলেন, ‘মূলধারার আওয়ামী লীগ এখানে কোণঠাসা। হাইব্রিড আর বিএনপি-জামায়াতের লোকজন দিয়ে আলাদা দল গড়ছেন এমপি রিমন। টানা ১০ বছরেও নিজেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রমাণ করতে না পেরে এখন তিনি তার সংসদ-সদস্যের ক্ষমতা ব্যবহার করে হাইব্রিড কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে দেখাতে চাইছেন তার সমর্থন।’ পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাবির হোসেন বলেন, ‘এই উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত এবং নৌকার বিরোধিতাকারীদের দিয়ে কমিটি করার মিশন নিয়েছেন রিমন। তিনি চান নিজের লোকজন দিয়ে পকেট কমিটি করে কেন্দ্রে অবস্থান জাহির করতে।’ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘বাবা যখন রাজাকার ছিল এমপি রিমন ছিলেন অনেক ছোট। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ভেবেছিলাম তার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু না, তিনি আওয়ামী লীগ ধ্বংস করার মিশন নিয়ে এসেছেন। এখন তৈরি করছেন রিমন লীগ।’ বেতাগী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মূলধারার বিপরীতে এমপি রিমন এখন বিএনপি-জামায়াত দিয়ে বি-টিম তৈরি করছেন।’
যা বললেন এমপি রিমন : দলীয় নেতাকর্মীদের এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এমপি রিমন। তিনি বলেন, এগুলো অপপ্রচার। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দুই উপজেলায় কমিটি গঠন হয়েছে। পাথরঘাটার কমিটি নিয়ে খানিকটা জটিলতা রয়েছে। সেখানে যারা পদ-পদবিতে আছেন, তারা পদ ছাড়তে চান না। কেন্দ্রের নির্দেশনাও মানছেন না। আমি চাইছি সেখানে কমিটি করতে। এ কারণেই তারা আমার নামে অপপ্রচার করছে। দলের প্রতি আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত না হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরপর তিনবার দলীয় মনোনয়ন দিতেন না।’ বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং নৌকার বিরোধিতাকারীদের দিয়ে কমিটি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোন কমিটিতে একজনও এ ধরনের লোক আছে, সেটা তারা প্রমাণ করুক। আমি নিজে আওয়ামী লীগ করি এবং কমিটিও আওয়ামী লীগের লোকজন দিয়েই হয়েছে।’
নতুন করে মাঠে বিএনপি : বরগুনা-২ আসনে বলতে গেলে কখনোই শক্ত অবস্থানে ছিল না বিএনপি। ১৯৮৪ সালে নির্বাচনি এলাকা গঠিত হওয়ার পর ৩৮ বছরে মাত্র দুইবার এখানে এমপি হয়েছেন দলটির প্রার্থী। তাও আবার যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা দুজনেই ছিলেন ধার করে আনা নেতা। স্বতন্ত্র হিসাবে পরপর দুবার এমপি হওয়া নূরুল ইসলাম মনি ২০০১ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন। এর আগে ১৯৮৬ সালে গোলাম সরোয়ার হিরু এমপি হলেও পুরোপুরি বিএনপির ছিলেন না তিনি। এরপর এখানে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করে হেরে যান জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে আসা প্রয়াত খন্দকার মাহবুব হোসাইন। মূলত মাহবুব হোসাইনের সময়েই বরগুনা-২ আসনে সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয় বিএনপি। বর্তমানে এখানে দলীয় মনোনয়ন চাইছেন সাবেক এমপি নূরুল ইসলাম মনি, অ্যাডভোকেট সগির হোসেন লিয়ন, জাকির খান এবং মনিরুজ্জামান মনির। তাদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে জনসমর্থন ও সাংগঠনিক ভিত প্রশ্নে সবার চেয়ে এগিয়ে মনি। দল নির্বাচনে গেলে নির্বাচন করবেন-এমন মনোভাবে এলাকায় যোগাযোগও বাড়িয়েছেন। নূরুল ইসলাম মনিকে কেন্দ্র করে এখানে বিএনপির নেতাকর্মীরাও চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। তবে নির্বাচনি এলাকায় থাকা তিন উপজেলায় সম্প্রতি বিএনপির যেসব আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে অভিযোগ। অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে এসব কমিটির পদ বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে জেলা কমিটির বিরুদ্ধে। জেলার নেতারা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বরগুনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলম ফারুক মোল্লা বলেন, ‘বিএনপির মতো একটি বড় দলে নেতা হওয়ার মতো যোগ্য অনেকেই থাকেন। সবাইকে তো আর পদ-পদবি দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া বর্তমানে আহ্বায়ক কমিটি করেছি আমরা। এই কমিটির কলেবর খুবই ছোট। যারা পদ-পদবি পাননি, তারা এসব মিথ্যা অভিযোগ করছেন। যখন পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে, তখন এ ধরনের অভিযোগ আর আসবে না। বরগুনায় বিএনপি আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। এখানে দলে কোনো বিভেদ কিংবা অনৈক্য নেই।’
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।