দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই
প্রকাশিত : ০৮:২৫ পূর্বাহ্ণ, ২৬ নভেম্বর ২০২২ শনিবার ৬০ বার পঠিত
একের পর এক প্রকল্প প্রস্তাবে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের অতিরিক্ত দাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের পর বছর এমন ঘটনা ঘটলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির নেই। ফলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নির্বিকার কর্তৃপক্ষ।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একটি প্রকল্প প্রস্তাবে একেকটি বালিশের দাম ধরা হয়েছিল ২৭ হাজার টাকা, বালিশ কাভারের দাম ২৮ হাজার টাকা। আবার একজন ক্লিনারের মাসিক বেতন ধরা হয়েছিল ৪ লাখ টাকা। আরেকটি প্রকল্পে একটি স্যালাইন স্ট্যান্ডের দামই ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা। এভাবে বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাবে প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন পণ্যের দাম অতিরিক্ত দেওয়া হয়।
এসব প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে কোনো কোনো সময় চিহ্নিত হয়। আবার অনেক সময় নানা ফাকফোঁকরে পার পেয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত-প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব অবশ্যই অপরাধ। এটি দুর্নীতি করার একটি সূক্ষ্ম কৌশল। এমন ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। অন্যথায় এই দুর্নীতির পথ কখনোই বন্ধ হবে না।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, এ রকম অতিরিক্ত ব্যয় বা ভুল ব্যয় প্রস্তাব কখনো কাম্য নয়। যারা এ রকম ব্যয় প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কেননা এটা করা না গেলে বারবার একই ভুল হতেই থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যাতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। আমার জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করছি। আইএমইডি এবং সিপিটিইউকে দিয়ে এ রকম অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব কমানোর বিষয়ে আরও কী করা যায় সেটি ভেবে দেখব। আমার মনে হয় কোনোভাইে ছাড় দেওয়া উচিত নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি করা এবং দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা দুটো একই ধরনের অপরাধ। উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে ধরার অর্থই হচ্ছে পরে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বাড়ানো হবে। এ রকম অসৎ উদ্দেশ্যেই এমন প্রস্তাব করা হয়। তবে কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে অনিয়মের উদ্দেশ্যেই এমন প্রস্তাব করা হয় এটা সর্বজনবিদিত। যখন পরিকল্পনা কমিশন চিহ্নিত করে যে, মাত্রাতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয় না বলেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
সূত্র জানায়, নদী ড্রেজিং প্রকল্পে সাইনবোর্ড স্থাপনে একেকটির খরচ ২ লাখ টাকা। কফি ও বাদাম চাষে ১০ কর্মকর্তার বিদেশ সফর, সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ২ কোটি টাকায় বাংলো নির্মাণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে ৪ কোটি টাকার অডিও-ভিডিও এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাবও আসে। ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে।
বলা হয়েছিল, দুর্নীতির সুযোগ রাখতেই এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, ভুল করে এমন প্রস্তাব যায় পরিকল্পনা কমিশনে। পরে সমালোচনা ও পরিকল্পনা কমিশনের চাপের মুখে এসব প্রস্তাব থেকে সরে এলেও যারা ভুল করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। তবে কোনো কোনো প্রকল্পে একজন কর্মকর্তাকে বদলি করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আবার কোনোটিতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চললেও শেষ হয় না।
পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এ রকম প্রস্তাব যারা করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটি করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকেই। তবে আমরা যে কাজটি করতে পারি সেটি হলো ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারি। এতদিন দু-একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা করেনি পরিকল্পনা কমিশন। তবে এখন সময় এসেছে শাস্তির বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার।
বিভিন্ন সময় প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে প্রস্তাব করা ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পায় পরিকল্পনা কমিশন। এক্ষেত্রে একটি বালিশের দাম যেখানে সাড়ে ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, সেখানে ধরা হয় ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। বালিশের কভারের দাম যেখানে ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছিল ২৮ হাজার টাকা করে। একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের দাম যেখানে সম্ভাব্য বাজার মূল্য ১০০-২০০ টাকা হওয়ার কথা সেখানে ধরা হয় ৮৪ হাজার টাকা। ৩০০-৫০০ টাকার রেক্সিনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছিল ৮৪ হাজার টাকা। স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম যেখানে ২০-৫০ টাকা হওয়ার কথা সেখানে প্রস্তাব আসে ৩৫ হাজার টাকা। ২৫০-১০০০ টাকা দামের কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ টাকা। এছাড়া ৫ এমএল সাইজের টেস্টটিউব-গ্লাস মেডের আনুমানিক বাজার মূল্য ১৫ থেকে ৫০ টাকা হলেও প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৬ হাজার টাকা।
এ রকম অনেক খাতেই অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। ব্যাপক লুটপাটের আশঙ্কায় এ রকম ১২টি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে প্রকল্পটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। তারপর সেটি আর সংশোধন হয়ে আসেনি।
অতিরিক্ত দাম প্রস্তাব ধরায় কোনো প্রকল্পে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) একেএম নুরুন্নবী কবিরের কাছে। তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। তাই তেমন কিছু বলতে পারব না। তবে কেউ যদি অপরাধ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ বা তার অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তবে প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়টি আমি আসার পর ঘটেনি।
সূত্র জানায়, এর আগে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা’ প্রকল্পে সাপোর্ট স্টাফদের অবিশ্বাস্য বেতন প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। অফিস সহায়কের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা এবং ক্যাড অপারেটরের বেতন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, বিদেশি পরামর্শকের মাসিক বেতন ধরা হয় ২৫ লাখ টাকা, যা গড়ে ১৬ লাখ টাকা।
এসব ব্যয় অত্যধিক বলে প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। পরে সংশোধনী প্রস্তাবে এসব ব্যয় স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কারও বিরুদ্ধে। একই অবস্থা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন প্রকল্পে। এতে স্যালাইন ঝোলানোর জন্য স্ট্যান্ডের দাম ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা। আর লুকিং গ্লাসের দাম ২০ হাজার টাকা। এ রকম অতিরঞ্জিত ব্যয়ের প্রস্তাব আসে পরিকল্পনা কমিশনে।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) এসব অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবনা নিয়ে চরমভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দায়ীদের বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রকল্প প্রস্তাবেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির পাঁয়তারা চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে একেকটি পালস অক্সিমিটারের (শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ যন্ত্র) দাম ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ১৫শ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে।
এছাড়া প্রতিটি ফেস মাস্কের দাম ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, যার বাজার দর ৫ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক দাম। পরে এ প্রকল্পের ধীরগতিসহ নানা বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির নির্দেশও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।
আরও আছে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পে অডিও-ভিডিও এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয় নির্বাচন কমিশন। যোগ্য জনবল থাকা সত্ত্বেও ৪ লাখ টাকা মাসিক সম্মানিতে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। সেই সঙ্গে ছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক সম্মানিতে পরামর্শক নেওয়ার প্রস্তাবও।
‘ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও জাতীয় পরিচিতি সেবা প্রদানে টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে এ চিত্র খুঁজে পায় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। কফি-বাদাম চাষে প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ সফর, ঘাস চাষ শিখতে বিদেশ সফর, পুকুর খনন শিখতে বিদেশ সফরসহ নানা অজুহাতে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব। এসব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি তুলে ব্যয় কমিয়ে দেয়। কিংবা বাতিলও করে দেওয়া হয়। কিন্তু যারা প্রস্তাব দেয় তাদের কিছুই হয়নি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ভুল-ত্রুটির অনেক অভিযোগ আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কতটা বিচ্ছিন্ন, নাকি সব ক্ষেত্রেই এ রকম ঘটনা ঘটছে এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি। অনেক সময় প্রকল্পে দুর্নীতি হলে তদন্ত কমিটি হয়। দীর্ঘ সময় পর ওই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। এটাই হচ্ছে সংস্কৃতি। প্রকল্পে ভুল প্রস্তাবের বিষয়ে তদন্ত কমিটি হওয়া উচিত। যারা ভুল-ত্রুটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক। শুধু বদলি তো কোনো শাস্তি হতে পারে না।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।