দিনে দিনে বাড়ছে বাধার মাত্রা, ভোগান্তিও
প্রকাশিত : ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ, ৫ নভেম্বর ২০২২ শনিবার ৯০ বার পঠিত
দিন যত যাচ্ছে বিএনপির গণসমাবেশে বাধাও তত বাড়ছে। দলটির কর্মসূচিতে জনসমাগম ঠেকাতে ক্ষমতাসীনদের বাধায় দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। ‘অবরুদ্ধ’ বরিশালে আজ শনিবার বিএনপির গণসমাবেশের আগে বাধার মাত্রা আগের চারটি বিভাগীয় কর্মসূচির চেয়ে অনেক বেশি। সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকায় সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বরিশালে লাখো মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে।
গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে জনসমাগম ঘটিয়ে আলোচনায় আসা বিএনপির প্রথম বিভাগীয় গণমাবেশ ছিল অনেকটাই নির্বিঘ্ন। তিন দিন পর ময়মনসিংহের কর্মসূচি থেকে শুরু হয় বাধা। জনসমাগম ঠেকাতে অঘোষিত ধর্মঘট এবং আওয়ামী লীগের পাহারা ছিল। পরের দুই সপ্তাহে খুলনা ও রংপুরে সমাবেশের আগের দিন থেকে ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘট ডেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখায় ব্যাপক জনদুর্ভোগ হয়।
তবে বাধার মাত্রায় বরিশাল সব সমাবেশকে ছাড়িয়েছে। শুধু বাস নয়, ধর্মঘট ডেকে গতকাল শুক্রবার থেকে বন্ধ করা হয়েছে অটোরিকশা, ইজিবাইকের মতো ছোট যানবাহনও। চলছে না লঞ্চ, ট্রলার ও ফেরি। খেয়াঘাটও বন্ধ। ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারও বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয় সকালে। যানবাহনবিহীন নগরটাই প্রায় অচল। উড়োজাহাজ ও হাতেগোনা কিছু প্যাডেলচালিত রিকশা ছাড়া কিছুই চলছে না।
ঢাকা থেকে গতকাল দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলার রুটে বাস চললেও বরিশালের ছয় জেলার বাস ছাড়েনি। বাকি সব পথে চললেও রাজধানীর সদরঘাট থেকে শুধু বরিশাল ও ঝালকাঠি রুটের লঞ্চ ছাড়েনি। বরিশালের প্রবেশপথে পাহারা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে আসার পথও রুদ্ধ।
শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে বরিশাল নগরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদে জহিরুল ইসলাম পলাশ নামে এক যাত্রী জানান, ঝালকাঠির রাজাপুরে গালুয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। মামির মৃত্যুর সংবাদে বাড়ি যাচ্ছেন। ফরিদপুর থেকে ৯৫০ টাকায় অটোরিকশায় বরিশালের ভুরঘাট আসেন। সেখান থেকে ভ্যানে শহরে এসেছেন। এখন কিছুই পাচ্ছেন না।
বরিশালের প্রবেশমুখ গৌরনদী বাস টার্মিনাল ও আগৈলঝাড়া সড়কে শুক্রবার সকালে পাহারা বসিয়ে আট-দশটি ইজিবাইক ভাঙচুর করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীরা। সমাবেশে যোগ না দিতে ক্ষমতাসীনদের হুমকি এবং বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি পুলিশের তল্লাশির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাধা এড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার থেকেই হেঁটে, সাইকেলে, নৌকায় বা বিকল্প উপায়ে বরিশালে আসছেন বিএনপির নেতাকর্মী। অনেকে চিড়া, মুড়ি, কাঁথা, কম্বল নিয়ে আসছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও পৌঁছেছেন। আজ দুপুর ২টায় এ গণসমাবেশ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে গণসমাবেশস্থল বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস পার্ক) অবস্থান নিয়েছেন দলটির হাজারো নেতাকর্মী। তাঁরা সেখানে মাদুর, পত্রিকা, পাটি পেতে ঘুমান বৃহস্পতিবার রাতে। উদ্যানে রান্না ও খাওয়া চলছে। সমাবেশস্থল হাত ছাড়ার আশঙ্কায় গতকাল সেখানেই জুমার নামাজ আদায় করেন। পৃথক দুটি জামাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও অংশ নেন। বিকেলে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল।
পটুয়াখালীর গলাচিপার আমখোলা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি জাকির হোসেন মোল্লা বৃহস্পতিবার বিকেলে এসেছেন সমাবেশস্থলে। তিনি জানান, তাঁরা ৫০ জন এসেছেন।
দশমিনা উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. ফোরকান খানও অর্ধশত নেতাকর্মী সঙ্গে নিয়ে বিছানা, বালিশসহ সমাবেশস্থলে আসেন বৃহস্পতিবার রাতে। উদ্যানেই রাত কাটান।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া থেকে আসা জসিম উদ্দিন আকন পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাঁর অভিযোগ, দ্রব্যমূল্যে টিকতে পারছেন না। এ কারণে কষ্ট হলেও এসেছেন নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবি জানাতে।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অবস্থান নেওয়া বিএনপির কর্মীরা দিনভর স্লোগান দেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুকের দাবি, যত বাধা ও হামলা হোক, আজ জনসমুদ্রে পরিণত হবে বরিশাল।
বিএনপির কর্মসূচির সময়ে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাধার অভিযোগ নাকচ করে দলটির জেলার সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেছেন, বিএনপি মিথ্যা বলে। সমাবেশে আসতে বাধা দিলে, হামলা হলে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে এত মানুষের জমায়েত হলো কী করে? বিএনপির কর্মসূচি পণ্ডের ইচ্ছা আওয়ামী লীগ নেই, ছিলও না।
গতকাল সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের একাধিক পক্ষ শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে নগরীতে মহড়া দেয়। এতে নেতৃত্ব দেওয়া জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাতের দাবি, বিএনপি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়, তাই ছাত্রলীগ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
এর আগে বিকেলে সমাবেশস্থল থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহামুদ জুয়েল মিছিলের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল হয় নগরীর বিভিন্ন সড়কে। দুই ছাত্রসংগঠনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে আতঙ্ক ছড়ায় বরিশালে।
মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবিতে ধর্মঘট আহ্বান করা বরিশালের বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাসরেক বাবুল বলেছেন, শনিবার বিকেল পর্যন্ত বাস চলবে না। একই কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট ডাকা তিন চাকার যানবাহনের শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি কামাল হোসেন লিটন মোল্লা। ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসও ধর্মঘট ডেকেছে। মালিক সমিতির সভাপতি মুজাহার উদ্দিন ও শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি নুরুজ্জামান জলিল বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়ি চলবে না।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান শিরিনের অভিযোগ, অন্যান্য বিভাগের মতো বরিশালেও পরিবহন নেতাদের ভয় দেখিয়ে ধর্মঘট ডাকিয়ে যানবাহন বন্ধ করিয়েছে সরকার। তবে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সরকারি দলের সম্পৃক্ততা নেই। মালিক-শ্রমিকরা নিজস্ব দাবিতে ধর্মঘট করছেন।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সমাবেশ মঞ্চ থেকে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪০টি মাইক লাগিয়েছে বিএনপি। নিরাপত্তায় বসেছে ২০টি সিসি ক্যামেরা। বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বলেছেন, কঠোর নিরাপত্তা থাকবে। পুলিশের ২০টি ভ্রাম্যমাণ টিম এবং স্ট্রাইকিং টিমও স্ট্যান্ডবাই কাজ করছে।
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে কুয়াকাটা। ব্যবসায়ীরা জানান, ছোট-বড় ১৫০টি হোটেল-মোটেলে পর্যটকে পূর্ণ থাকে শুক্র ও শনিবার। ধর্মঘটে দুই দিনে অন্তত ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ঢাকার মিরপুর-১১ থেকে কুয়াকাটা যাওয়া পর্যটক মো. শহিদুজ্জামান শহিদ জানান, ধর্মঘটে আটকা পড়ে ক্ষতি হলো।
এদিকে, বরিশালের গণসমাবেশে যাওয়ার পথে হামলার শিকার হলেন পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান খান।
হামলায় আহত শাহজাহান খানের ছেলে জেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শিপলু খান জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহজাহান খান বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার পথে পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের গাবুয়া এলাকা অতিক্রমকালে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় শাহজাহান খানকে বহনকারী মোটরসাইকেল চালক সাইদুল ও শাহজাহান খান নিজেও আহত হন। একই সময়ে হামলায় ইসাহাক ও শাহ আলম নামে অপর দুইজন কর্মী আহত হন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি আব্দুল মান্নান জানান, বিএনপির কোনো ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ত নয়। এসব বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে হচ্ছে।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, সড়ক ও নৌপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দ্বীপ জেলা ভোলা। স্পিডবোটও চলছে না শুক্রবার সকাল থেকে। বাস বন্ধ থাকায় অটোরিকশায় দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া আদায় করা হয়।
চরফ্যাসন থেকে অসুস্থ স্ত্রী শারমিন ও ছেলে ইসমাইলকে নিয়ে ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে এসে আটকা পড়েন বিল্লাল হোসেন। তিনি জানান, স্ত্রীকে ডাক্তার দেখানোর নির্ধারিত তারিখ থাকায় অটোরিকশায় বেশি ভাড়া দিয়ে ঘাটে এসেছেন। কিন্তু বরিশাল যেতে পারেননি।
বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির মল্লিক, পৌর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক দুলালসহ আরও কয়েক নেতার বাড়িতে মধ্যরাতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। পৌর বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসাইন জানান, শিক্ষক প্রশিক্ষণে তিনি বরিশালে রয়েছেন। তবুও তাঁর বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে।
বেতাগী থানার ওসি শাহ আলম হাওলাদার বলেন, বিএনপির কয়েকজন নাশকতার জন্য অস্ত্র মজুত করেছেন বলে খবর ছিল। সত্যতা যাচাইয়ে অভিযান চালানো হয়। অস্ত্র না পাওয়ায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, ট্রাক, পিকআপ, মোটরসাইকেল এবং নদীপথে ট্রলার, মালবাহী বার্জ ও কার্গোতে বিএনপির নেতাকর্মীরা বরিশাল গেছেন। বিএনপি কর্মীরা সমাবেশে যেতে পারলেও, বাস না চলায় পিরোজপুরের সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, এ জেলায়ও ভুগছেন সাধারণ মানুষ। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে ঝালকাঠি থেকে কালিজিরা পর্যন্ত যেতে ভাড়া নিচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের অনেক বেশি ৩০০ টাকা। মোটরসাইকেল চালক মনির খান জানান, কালিজিরা পর্যন্ত যাওয়ার পর পুলিশ আটকে দিচ্ছে। বরিশাল যেতে দিচ্ছে না।
শুক্রবার সকালে ঝালকাঠি টার্মিনালে এসে বাস না পেয়ে ব্যবসায়ী ইমাদুল ইসলাম ও অপর যাত্রী উত্তম পাল অটোরিকশায় বরিশালের পথে রওনা হন। তাঁরা বলেন, বিএনপির সমাবেশ হচ্ছে সমাবেশের মতোই। ভুগছে মানুষ।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।