দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই চলে লাইট ফ্যান
প্রকাশিত : ০৬:০৫ পূর্বাহ্ণ, ২৬ জুলাই ২০২২ মঙ্গলবার ১৪৪ বার পঠিত
দেশে বিদ্যুতের অপচয় কমাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সব সরকারি দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার হ্রাস এবং জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের জন্য পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এ অবস্থায় অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজন ছাড়াই দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলছে ফ্যান-লাইট। এতে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণের বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনার পরও এ অপচয় বন্ধ হচ্ছে না।
গত এক সপ্তাহ সরেজমিন রাজধানীর একাধিক সরকারি হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। কোনো প্রয়োজন নেই এরপরও দিনের আলোর মধ্যেই বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। ফ্যান, শীতাতপ যন্ত্র (এসি) ও পানির অপচয় হতে দেখা গেছে। মাসের পর মাস ধরে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এভাবে অপচয় হলেও তা রোধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীদের প্রয়োজনে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিতের দরকার আছে। তবে দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ে যখন জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন প্রয়োজন ছাড়াই বিদ্যুতের অপচয় আরও ভোগান্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে চরম সংকটকালে বিদ্যুৎ ব্যবহারে হাসপাতালসহ সবখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। অপচয় রোধে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রোগীর স্বজনদের সচেতন হতে হবে।
গত বুধবার দুপুরে রোদের আলো ঝলমল করছিল, ঠিক তখন কলেজ গেটের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালের জরুরি ও আন্তঃবিভাগ লেখা সাইনবোর্ড ও অনুসন্ধান কক্ষসহ বহির্বিভাগে অন্তত শতাধিক পাওয়ারে ২০টা লাইট জ্বলতে দেখা গেছে। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে নিচতলার মেডিসিন ভর্তি ওয়ার্ড পর্যন্ত ১০টার বেশি লাইট ও ফ্যান চলছিল। হাসপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগে কোম্পানির এলইডি ডিজিটাল দোকান চালানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিচতলার ক্যান্টিনের সাইনবোর্ডও এলইডি করা হয়েছে। বহির্বিভাগের দ্বিতীয়তলার হেড নেক সার্জারি, রিউমাটোলজি, রেসপিরেটরি মেডিসিন, চক্ষু, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বারান্দা এবং করিডরে কোনো মানুষজন না থাকলেও অন্তত ৪০টি লাইট ও ১০টির মতো ফ্যান চলছিল। অব্যবহৃত আইসিইউ কক্ষ ও সংস্কারাধীন ওয়ার্ডে বিনা প্রয়োজনে বাতি জ্বলছিল। এভাবে পুরো হাসপাতালের বারান্দা, করিডর, সিঁড়ি ও বন্ধ কক্ষে দিনের স্পষ্ট আলোতে প্রয়োজন ছাড়া প্রায় ২০০ লাইট ও ৫০টির মতো ফ্যান চলতে দেখা গেছে।
পাশের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও বিদ্যুৎ অপচয় দেখা যায়। জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে শুধু ভেতরেই নয়, তারা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ অপচয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে। দুই হাসপাতালের মাঝের ফাঁকা জায়গায় ১৪টি ভাসমান খাবার ও মুদি দোকানে গোপনে হাসপাতালের লাইন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও দিন-রাতে একাধিক ফ্যান ও লাইট চালানো হচ্ছে।
একইভাবে শিশু মেলা থেকে শুরু করে শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা খাবার হোটেল, ফার্মেসি, সার্জিক্যাল দোকান, রাজনৈতিক অফিস ও জুতা-স্যান্ডেলের দোকানসহ দুই শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানে রাস্তার বৈদ্যুতিক লাইন থেকে অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া হয়েছে।
দুপুরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের সি-ব্লকে ঢুকতে ও নিচতলার লিফটের সামনে দুটি বাতি জ্বলতে দেখা যায়। দ্বিতীয়তলার হিস্টোপ্যাথলোজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ব্ল্যাড স্যাম্পল কালেকশন বুথের সামনে লোকজন না থাকলেও একাধিক লাইট ও ফ্যান চলতে দেখা যায়। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য তরিকুল বলেন, প্রতিদিনই তো ফ্যান-লাইট চলে। এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করে না। অথচ সূত্র জানায়, শিশু হাসপাতালের এ, বি ও সি ব্লক মিলে প্রায় ২৩ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়।
তবে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিদ্যুতের অপচয় রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরই তিনি প্রত্যেক বিভাগের চিকিৎসক, নার্স ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয় আনসার সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। নিজেও তদারকি করছেন। নজরদারি বাড়াতে সবাইকে সচেতন করতে আজ থেকে আরও কড়াকড়ি করা হবে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ভরদুপুরের স্পস্ট আলোতে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও বিভাগে লাইট-ফ্যান চলতে দেখা যায়। এর মধ্যে অনুসন্ধান কক্ষ, জরুরি বিভাগ, জরুরি অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স, এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, আল্ট্রাসনোগ্রাম, প্যাথলজি, ব্লাডব্যাংক, ব্রেস সেন্টার, ফিজিওথেরাপি বিভাগ অন্যতম। এছাড়া পরিচালক অফিস, একাডেমিক অফিস, রেন্ট কালেক্টর কক্ষ, স্টাফ ক্যান্টিন ফিজিও থেরাপি ক্লাস রুম ইসিজি রুমে লোক না থাকলেও বাতিল জ্বলে ও ফ্যান ঘোরে। পোস্ট অপারেটিভ কক্ষ, কেবিন ব্লক, লাইব্রেরি, থেকে শুরু করে সবগুলো ওয়ার্ডের সামনের বারান্দা, করিডর ও সিঁড়িতে রাতদিন অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। হাসপাতালের আনসার সদস্য সাহাবুদ্দিন, রেজাউল করিম, প্রশান্ত ও বেশ কয়েকজন চিকিৎসক-নার্সের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, লাইট-ফ্যান ওয়ার্ড মাস্টার দেখে। এ ব্যাপারে কথা বলতে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে সেখানেও প্রায় সবখানে দিনের বেলায় লাইট-ফ্যান চলতে দেখা যায়। একাধিক রোগীর স্বজন বলেন, ওয়ার্ডগুলোতে ফ্যানের দরকার হলেও দিনের আলোতে বারান্দা ও কক্ষে লাইটের দরকার পড়ে না। কিন্তু বিনা কারণে অনেক লাইট-ফ্যান চললেও দেখার কেউ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. বেলাল হোসেন বলেন, কোনো কোনো হাসপাতালের কিছু জায়গায় দিনের বেলাতেও লাইট না জ্বালালে অন্ধকার থাকে, যেখানে আলোর প্রয়োজন হয়। অনেক সময় করিডর, বারান্দা, প্যাথলজি ল্যাব, ব্লাডব্যাংকের সামনে রোগীর স্বজনরা লাইট-ফ্যান ব্যবহার করেন। অপ্রয়োজনে অপচয়, ঠিক নয়। একজন সুনাগরিকের গুণাবলিও এটা নয়। প্রধানমন্ত্রী অপচয় বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। অপচয় রোধে পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলা ও খোঁজ নেওয়া হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হাসপাতালের কাজ জরুরি সেবা দেওয়া। সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় বিদ্যুৎ-পানি অপরিহার্য, এর বিকল্প নেই। তবে সদিচ্ছা থাকলে সেখানেও সঞ্চয় করা যায়। এজন্য নজরদারি থাকতে হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে এ ধরনের আচরণ সবাই আশা করে। না হলে সরকারি নির্দেশ অমান্য হচ্ছে। সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা সরকারের নির্দেশ বা নীতিমালা অমান্য করেন এটা নতুন দৃষ্টান্ত নয়। ফলে যারা মানছেন না তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে অপচয় বন্ধ হবে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।