ঢাকায় ছিনতাইয়ের ৪৩২ হটস্পট
প্রকাশিত : ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শুক্রবার ১৫ বার পঠিত
রাজধানীতে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ছিনতাই। নগরীর ৫০ থানা এলাকায় ছিনতাইকারীদের ৪৩২টি হটস্পট চিহ্নিত হয়েছে। এসব স্থানে সক্রিয় ১২শ ছিনতাইকারী।
এদের হাতে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন মানুষ। দুর্বৃত্তরা চলন্ত বাস, প্রাইভেট কার থেকে মোবাইল ফোন, কানের দুল, গলার চেইন টেনে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় প্রকাশ্যে ছুরি, চাকু, চাপাতি বা পিস্তল ধরে নগদ টাকা, মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নিচ্ছে। বাধা দিলেই আঘাত করছে এতে গুরুতর আহতসহ প্রাণহানি হচ্ছে।
এসবের সঙ্গে পেশাদার, মাদকাসক্ত এবং শৌখিন ছিনতাইকারীরা জড়িত। এদের দৌরাত্ম্যে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেক এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাতে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী অভিযানেও দমছে না অপরাধীরা।
এই অবস্থায় দিনে দিনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ভুক্তভোগীরা। অনেক স্থানে নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। অনেক স্থানে মানুষ হাতে তুলে নিচ্ছেন আইন। ছিনতাইকারীদের ধাওয়া দিয়ে ধরে গণধোলাই, এমনকি উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা, পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটছে। অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিতে পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। পুলিশের দাবি, কোনো স্পট ধরে নয়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নের ঝুঁকি আছে, সেখানেই অভিযান চালানো হচ্ছে।
বিভাগভিত্তিক ৪৩২ হটস্পট : একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ছিনতাইয়ের হটস্পটের সংখ্যা ৩৪২টি। এগুলোর মধ্যে তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় আছে ১০৮টি স্পট। শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, শিল্পাঞ্চল এবং হাতিরঝিল থানা এলাকায় ২৫ স্পট।
বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় রয়েছে ৯৫টি হটস্পট। গুলশান ও উত্তরা বিভাগে আছে ৯৪টি এবং মতিঝিল বিভাগে-৩০, ওয়ারীতে-৩৫, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ৪৫টি হটস্পট আছে বলে জানা গেছে। এসব স্পটে ছিনতাইয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১২শ অপরাধী। এর মধ্যে মতিঝিল বিভাগ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ২১২ জন, মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে সক্রিয় ৩৮৬, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২১৭, উত্তরা এবং গুলশান বিভাগে ১৫৪, মোহাম্মদপুর থানার আওতাধীন এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইকারী সক্রিয়ভাবে জড়িত।
গত কয়েক দিনের চিত্র : কিছু দিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ লুট, আদাবর ও মোহাম্মদপুরে পৃথক ছিনতাইসহ একাধিক ঘটনা আলোচনায় আসে রোববার রাতে। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার জরুরি সংবাদ সম্মেলন, কোর কমিটির বৈঠক শেষে চলছে রাজধানীতে কম্বাইন্ড অপারেশন।
এরই মধ্যে বুধবার রাতে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় উত্তরার বিএনএস সেন্টার এলাকায় নাজিম ও বকুল নামে দুই ছিনতাইকারীকে জনতা ধরে ফুটওভার ব্রিজের ওপর উলটো করে ঝুলিয়ে রাখে। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তাদের ভিডিওটিও ভাইরাল হয়ে যায়।
এদিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় নগরজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোববার রাতে বনশ্রীতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ ছিনতাইসহ একাধিক ঘটনার পর সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে র্যাব, এটিইউ এবং সিটিটিসির ‘কম্বাইন্ড অপারেশন’ শুরু করে। সোমবার রাত থেকে এ অভিযান অব্যাহত আছে।
ছিনতাইয়ে তিন ধরনের অপরাধী : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে তিন ধরনের অপরাধী জড়িত। একদল পেশাদার ছিনতাইকারী। এরা সংঘবদ্ধভাবে ছিনতাই করে। এদের প্রত্যেক গ্রুপে ৪ থেকে ৫ জন সদস্য থাকে। কখনো তারা নির্দিষ্ট স্পটে অবস্থান করে ছিনতাই করে। আবার কখনো সিএনজি কিংবা প্রাইভেটকার নিয়ে দিনে বা রাতে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে। এদের মধ্যে ছিনতাইয়ের টার্গেট বিনিময় হয়। এক এলাকার টার্গেট অন্য এলাকার ছিনতাইকারীর কাছে বিক্রির নজির আছে বহু।
আরেক ধরনের ছিনতাইকারী রয়েছে, যারা মাদকের টাকা জোগান দিতে ছিনতাইয়ে নেমে পড়েছে। এদের অধিকাংশই ভাসমান কিংবা বস্তির বাসিন্দা। এরা রাস্তাঘাটে ওতপেতে থাকে। বিভিন্ন পরিবহণের যাত্রী কিংবা পথচারীর মোবাইল ফোন, কানের দুল, ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। আরেক ধরনের ছিনতাইকারী রয়েছে, যারা শৌখিন হিসাবে পরিচিত। এদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বখে যাওয়া শিক্ষার্র্থীও আছে।
এরা শখের বসে ছিনতাইয়ে নামে। দামি মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো এসব অপরাধীরা টার্গেটের ল্যাপটপ কিংবা দামি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এক সময় ছিনতাইকারীরা রাতের অন্ধকারে বা ভোরে রাস্তায় নেমে মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিত। কিন্তু এখন ভোর, সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত সব সময় তাদের দাপট চলে।
সরেজমিন পাঁচ হটস্পট : বুধবার সরেজমিন নগরীর ছিনতাইপ্রবণ ৫টি এলাকা ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভয়াবহ বর্ণনা। উত্তরা এলাকার ছিনতাইয়ের অন্যতম হটস্পট হাউজ বিল্ডিং এলাকা। এখানে দিনে-রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। উত্তরার অনেক বাসিন্দা সন্ধ্যার পর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হন না।
বুধবার উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকা, বেলা ১১টায় আব্দুল্লাপুরগামী ভিক্টর পরিবহণে বসে ফোনে কথা বলছিলেন এক যাত্রী। হঠাৎ এক ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। লোকজন তাকে ধাওয়া করলেও ধরতে পারেনি।
হাউজ বিল্ডিং এলাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ী আরিফ বলেন, এই এলাকায় প্রতিদিনই বাস যাত্রীদের কারও মোবাইল ফোন, কারও কানের দুল টেনে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তিনি বলেন, আগে ছিনতাইকারীদের পিছু নিত না কেউ। কিন্তু মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। যে কারণে তাদের ধাওয়া দেয়, ধরার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, বুধবার রাতে জনতা দুই ছিনতাইকারীকে ধরে বিএনএস সেন্টার এলাকায় ব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিল।
আরেক হটস্পট পল্লবীর পূরবী এলাকা। এই এলাকায় মেট্রোরেলের নিচে প্রধান সড়কে এবং আশপাশের গলির মুখে প্রায়ই হানা দেয় ছিনতাইকারী। একাডেমিয়া স্কুলের পাশের ফুটপাতের এক ব্যবসায়ী বুধবার বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ওই গলির মুখের সামনের রাস্তায় যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক। হঠাৎ তাকে ঘিরে ধরে তিনজন। তাকে একটি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যায় গলির ভেতরে।
এরপর তার মোবাইল ফোন, সঙ্গে থাকা দুই হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আমার সামনে ওই যুবককে তুলে নিয়ে গেল ছিনতাইকারীরা। এদের প্রত্যেকের হাতেই চাকু ছিল। আমি কিছু বলার সাহস পাইনি। তার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়ার পর ছেড়ে দেয়। তিনি বলেন, এই গলির মুখে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। স্কুলের পাশ থেকে একটি টবসহ গাছ নিয়ে যাচ্ছিল এক ছিনতাইকারী। আমি বাধা দিলে সে চাকু নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে।
দারুসসালাম থানাধীন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ফাঁকা জায়গা ছিনতাইয়ের আরেক হটস্পট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে ভাসমান মাদকাসক্ত এবং পেশাদার অপরাধীরা কবরস্থানের আশপাশে অবস্থান নেয়। সুযোগ পেলেই লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অর্থকড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই এলাকার মাঝে-মধ্যে পুলিশ আসে। তবে অপরাধীরা সাইরেনের শব্দ শুনে পালিয়ে যায়।
আদাবর থানাধীন শ্যামলী বাস স্টপেজ এলাকাও ছিনতাইয়ের হটস্পট। এই এলাকায় প্রতি রাতেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এলাকার রিকশা আরোহী এবং বিভিন্ন পরিবহণের যাত্রী ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। মলি আজাদ নামের এক নারী বলেন, কয়েকদিন আগে শ্যামলী ওভার ব্রিজের নিচে আমার মেয়ে গাড়ির গ্লাস খোলা রেখে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ এক ছিনতাইকারী এসে তার নতুন ফোনটি টেনে নিয়ে পালিয়ে যায়। আমার মেয়ে ওই সময় ভয় পেয়ে যে চিৎকার দিয়েছিল, তা এখনো আমার কানে বাজে।
আদাবরের শেখেরটেক ছিনতাই প্রবণ এলাকা। স্থানীয় চা দোকানি পারভিন বেগম বলেন, প্রায়ই এই এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ভোররাতে চিৎকার শুনি মানুষের। তিনি বলেন, রোববার রাতে স্বামী-স্ত্রী রিকশায় যাচ্ছিলেন। চাপাতি নিয়ে তাদের পথরোধ করে সবকিছু কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এই এলাকায় যারা ছিনতাই করে, তারা মুখপরিচিত। ভয়ে আমরা তাদের কিছু বলি না।
মারিয়া রুমী নামের এক ভুক্তভোগী জানান, আমি গত কয়েকদিন আগে আমার চাচাকে নিয়ে রাতে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে দুই ছিনতাইকারী এসে আমাদের পথরোধ করে নগদ সাত হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
যা বললেন বিশ্লেষকরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধীরা যেমন কৌশল পালটে অপরাধ করছে, তেমনি তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কৌশল পালটে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে পেশাদার ছিনতাইকারীর পাশাপাশি মাদকাসক্ত এবং অভাবগ্রস্তরাও জড়িয়েছে। তিনি বলেন, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো ভূমিকার বিকল্প নেই।
ঢাবির অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক শূন্যতা তৈরি হয়েছে পুলিশের মাঝে। দেশে বড় পরিবর্তনের পর এই সময়ে অপরাধীরা এই সুযোগ নিয়ে ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধে তৎপরত হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশকে পুনরুজ্জীবিত করার যথাযথ উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, গত এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল। গত কয়েক দিনের ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে। তবে অন্যান্য অপরাধ নেই বললেই চলে। সব অপরাধ আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের মূল কাজ ছিনতাইকারীদের দমন করা।
ঢাকা মেট্রোলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশের কাছে হটস্পট বলে কিছু নেই। যেই এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, সেখানেই অভিযান চালানো হচ্ছে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।