শনিবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

টেকসই গ্রন্থাগারের জন্য এমপিওভুক্তি দরকার

প্রকাশিত : ০৫:৩৬ অপরাহ্ণ, ৬ জুন ২০২২ সোমবার ৬৬ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। ফলে তার ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে যায়। জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হলে সবার আগে দরকার শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু এজন্যই শুরুতে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করেন। বিনা খরচে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ লাভ করে এদেশের জনগণ। তিনি বেঁচে থাকলে পরবর্তীকালে হয়তো দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা পালটে যেত, জাতীয়করণ হয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। যা হোক, দীর্ঘদিন পর জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশ ‘পথের দিশা’ পায়, উন্নয়নের মাহসড়কে যাত্রা শুরু করে। বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। তাই উন্নয়নবান্ধব, শিক্ষাবান্ধব ও গ্রন্থাগারবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রতাশ্যা অনেক। আমাদের দাবি, দেশের বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে সঠিক জরিপের মাধ্যমে যাচাইবাছাই করে স্কুল-মাদরাসা-কলেজের আদলে ‘এমপিও’ দেওয়া হোক। নইলে একদিকে এগুলো যেমন টিকবে না, তেমনি আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, অতিমারি করোনা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্য বিশ্বকে তাক লাগালেও একটি ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তা হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের দেশে সরকারি গণগ্রন্থাগার মাত্র ৭১টি, আর বেসরকারি গ্রন্থাগার ১.৪৯৪টি। দেশে ৫ শতাধিক উপজেলা/থানা সদরে মাত্র তিন জায়গায় সরকারি গণগ্রন্থাগার আছে। আর যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো নিভু নিভু।

জ্ঞানভিত্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও আলোকিত সমাজ গঠনে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে আমরা মনে করি। এজন্য প্রয়োজন সঠিক ‘দিক নির্দেশনা’, ‘রোডম্যাপ’ বা ‘পথনকশা’। বিকল্প নেই। মানবিক গুণাবলীর ‘সুনাগরিক’ তৈরিতে গ্রন্থাগার বা পাঠাগারের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু তা রীতিমতো উপেক্ষিত। সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারের পরিসংখ্যানেই তা পরিষ্কার। দেশে মাথা গুনতির জনসংখ্যা বাড়লেও ‘সুনাগরিক’ তৈরি হচ্ছে না। ইউনেস্কোর মতে, প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় একটি ‘গণগ্রন্থাগার’ থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমরা এর ধারেকাছেও নেই।

আমরা জানি, পশুমাত্রই নিজগুণে পশু। বনে-বাদাড়ে, যত্রতত্র জন্মায়। কিন্তু মানবসন্তানকে ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন করতে হয়। ‘মানবিক গুণাবলী’ অর্জন করতে হয়। শিক্ষা অর্জন করতে হয়। পাঠ গ্রহণ করতে হয়। শিশুর প্রথম পাঠশালা তার ‘পরিবার’। মা প্রথম শিক্ষক, এরপর বাবা, ভাইবোন ও স্বজনদের অবস্থা। শিশু মায়ের ‘বোল’ (ভাষা) ও হাঁটা শেখার পর তাকে পাঠানো হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি প্রভৃতি স্তর পার হয়ে পরিণত ‘নাগরিক’ হয়। তবে শুধু নাগরিক হলে চলবে না, ‘সুনাগরিক’ হতে হবে। শুধু শিক্ষিত হলে চলবে না, ‘সুশিক্ষিত’ হতে হবে। এখানেই মূল কথা থেকে যায়।

আমি পেশাদার গ্রন্থাগারিক নই, সংগঠক মাত্র। অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা বলা আবশ্যক মনে করি। পাঠকসৃজন বা তৈরি করার জন্য কিছু সেক্টর বা খাত আছে। যেমন : (ক) পরিবার (খ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (গ) সমাজ (ঘ) কর্মস্থল ও (ঙ) রাষ্ট্র।

(ক) পরিবার : আগেই বলা হয়েছে, পরিবার শিশুর আদর্শ পাঠশালা। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়দের অনুকরণ করে, দেখে শিখে। পরিবারের সদস্যরা বই পড়লে শিশুরাও অনুরক্ত হয়। তাই প্রতি পরিবারে ‘পারিবারিক গ্রন্থাগার’ থাকা দরকার। এটা গড়া খুব কঠিন কাজ নয়। সংসার খরচ থেকে মাসে কিছু টাকা বাঁচাতে হবে। সেই টাকা দিয়ে তিন মাস, ছ’মাস অন্তর বা বছরে অন্তত একবার বই কিনতে হবে। বাচ্চাদের নিয়ে বইমেলায় যেতে হবে। এটা বড়দের দায়িত্ব। এতে ‘মনের জানালা’ খুলে যাবে। জ্ঞানান্বেষণে আগ্রহ বাড়বে। আজকাল অনলাইনেও বই কেনা যায়। তবে প্রকাশনা সংস্থা বা বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে যাচাইবাছাই করে বই কিনলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কারণ আজকাল কাটতি বইয়ের নকল কপিও বাজারে বিস্তর। মানসম্মত বই পেতে প্রকাশনা সংস্থার ক্যাটালগ সংগ্রহ করতে হবে। ‘একুশে বইমেলা’ ক্যাটালগ সংগ্রহের আদর্শ স্থান। ক্যাটালগ ধরে, পছন্দের বইয়ের তালিকা করে, পর্যায়ক্রমে বই সংগ্রহ করা যেতে পারে।

(খ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : অনেকের বাড়িতে বই-পুস্তক নেই, বাড়তি বই পড়ার সুযোগ নেই, এককথায় অনুকূল পরিবেশ নেই। বড়রা বই পড়ে না, আগ্রহ কম। সে ক্ষেত্রে পাঠক তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই ‘একাডেমিক বা শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার’ থাকতে হবে। পর্যাপ্ত বই থাকতে হবে। বছর বছর বই বাড়াতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও অন্য শিক্ষকদের আগ্রহ বা তাগিদ থাকতে হবে। শিক্ষকরা নিজেরা বই পড়বেন, শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। গ্রন্থাগারিক নিয়মিত বই ইস্যু করবেন, জমা নেবেন। ক্লাস রুটিনে ‘গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবস্থাপনা’ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(গ) সমাজ : জনপ্রতিনিধি, শিক্ষানুরাগী, সমাজহিতৈষী যে কেউ ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক উদ্যোগে ‘সাধারণ গ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এভাবেই দেশের বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো গড়ে উঠেছে। গণগ্রন্থাগারের দ্বার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত। তাই গণগ্রন্থাগারকে গণবিশ্ববিদ্যালয় বা ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’ বলা হয়।

(ঘ) কর্মস্থল : অনেক কল-কারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ‘রিক্রিয়েশন সেন্টার’ বা ‘বিনোদন ক্লাব’ আছে। সেখানে ‘বুক কর্ণার’ বা ‘গ্রন্থাগার’ কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সুযোগ পেলে অলস সময় পার না করে বই পড়তে পারেন। অফিস ছুটির পর ইস্যু করে বাড়িতে নিয়ে বই পড়তে পারেন। আলাদা গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টি করা যায়।

(ঙ) রাষ্ট্র : রাজধানী, বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে সরকারি গ্রন্থাগারগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। দেশের প্রতিটি উপজেলা/থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন সদর পর্যায়ে সরকারি গণগ্রন্থাগারের শাখা স্থাপন করা উচিত। সেগুলো অবশ্যই পাঠকবান্ধব হতে হবে।

দেশে দুই ধরনের গ্রন্থাগার আছে, সরকারি ও বেসরকারি। সরকারি গণগ্রন্থাগার রাষ্ট্রীয় খরচে পরিচালিত হয়। আর বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো পরিচালিত হয় বেসরকারি অনুদানে।

বেসরকারি গ্রন্থাগার : আগেই বলা হয়েছে দেশে বেসরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১ হাজার ৪৯৪। বিভাগওয়ারি গ্রন্থাগারগুলো হচ্ছে ঢাকা ৩০৭, চট্টগ্রাম ২০৪, রাজশাহী ২২৭, খুলনা ২৩৪, সিলেট ৪৬, বরিশাল ১৩০, রংপুর ২২৫, ময়মনসিংহ ৯১।

বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতির (বাগসুস) মতে, আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় বেসরকারি গ্রন্থাগার তিন ধরনের, ১. স্বয়ম্ভর : নিজ জমিতে গড়ে ওঠা গ্রন্থাগার, যাদের স্বতন্ত্র আয়ের উৎস আছে ২. ব্যক্তি নির্ভর : নিজস্ব জমি নেই। ভাড়া বাড়িতে বা কারও দেওয়া জমিতে অস্থায়ীভাবে ঘর তুলে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দানশীল ব্যক্তি বা পরিবার পাঠাগার পরিচালনার ব্যয় বহন করে ৩. সদস্য চাঁদা নির্ভর : নিজের জমি বা ভাড়া বাড়ি যেখানেই হোক, পরিচালনার জন্য সদস্যদের চাঁদার ওপর নির্ভরশীল।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে অনুদান প্রদানের লক্ষ্যে প্রতি বছর নিবন্ধিত বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর কাছে দরখাস্ত আহ্বান করে। ক, খ ও গ শ্রেণিতে বাছাই করে অনুদান দেওয়া হয়। বরাদ্দ অর্থের অর্ধেক টাকার চেক ও বাকি টাকার বই দেওয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫০টি বেসরকারি গ্রন্থাগারকে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে সরকার।

দাবি একটাই : বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে ‘গ্রন্থাগার আন্দোলন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। সংগঠনের স্লোগান, ‘বই পড়ি, গ্রন্থাগার গড়ি’। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, স্বাধীনতার অর্ধ শতকে দেশে ন্যূনতম উপজেলা/থানা পর্যায়ে সরকারি গ্রন্থাগার বিস্তার লাভ করেনি।

এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বাংলাদেশ গ্রন্থাগার আন্দোলন

emdadhb@yahoo.com

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



© ২০২৩ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT