শনিবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এক কেজি চাল দিন আর এক ব্যাগ প্লাটিলেট

প্রকাশিত : ০৮:১৫ পূর্বাহ্ণ, ২৯ আগস্ট ২০২৩ মঙ্গলবার ২৭ বার পঠিত

অনলাইন নিউজ ডেক্স :

প্রাণের স্বজনরা আবার ছবি হয়ে যাচ্ছে। কারও শিশুপুত্র-কন্যা, কারও স্ত্রী, কারও ভাইবোন ডেঙ্গুতে ভুগে ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে! মৃত্যুভয় বড় ভয়। সেই ভয় আবার আনাগোনা করছে বিভিন্ন জনপদে। কিন্তু কে আছে? কী আছে? হাসপাতালে বেড নেই, প্লাটিলেট নেই। পেলেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। যে পারছে সে যথেষ্ট খরচ করে চিকিৎসা করাচ্ছে। যে পারছে না, সে খোদার কাছে বিচার দিয়ে নেতিয়ে পড়ছে চিরতরে।

কিংবা অর্থ থাকলেও কি বাঁচানো যাচ্ছে সবাইকে? ডেঙ্গু জ্বর এখন জাতীয় দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দেশ পরিচালনা দেখে মনে হয় না– মানুষ বিপদে আছে, ভয়ে আছে। করোনা মহামারির সময় সরকার যতটা তৎপর ছিল; ধনীরা যতটা দানবীর হতে চাইতেন; মধ্যবিত্তরা যতটা দরদি ও সহযোগী ছিলেন; ডেঙ্গু মোকাবিলায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে কি? চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি ব্ল্যাক ডেথ নামক প্লেগে ইউরোপের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ মারা যায়। মহামারি শেষ হলে দেখা যায়, মানুষ তখন সব ভুলে যেতে চায়। মানুষ অনেক বস্তুবাদী আর ভোগবাদী হয়ে পড়েছিল; স্বার্থপর হয়ে পড়েছিল। আমাদের দেশেও কি কভিড-পরের কালে সেটাই ঘটছে?

বিচক্ষণ মানুষেরা সুসময়কে ক্ষণস্থায়ী ভাবেন; আর আমার বা আমাদের মতো বোকা মানুষেরা ভাবেন, খারাপ সময়টা কেটে যাবে। কিন্তু কাটছে কই? করোনার দুই বছরের পর লাগাতার হানা দিচ্ছে ডেঙ্গু। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটছে এখন অনেকের ঘরে। বিপদের সেরের ওপর সোয়া সের হয়ে এসেছে ডেঙ্গু জ্বর। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু আগের বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। ২০২৩ সাল পেরোয়নি; এই আট মাসেই ২০২২ সালকে ছাপিয়ে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড গড়েছি আমরা। এদিকে মশা মারার ওষুধে ভেজাল। নগর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, তাদের বেশি কিছু করার নেই। কিছু করতে হলে তাদের নাকি আরও টাকা চাই। জি, টাকা ছাড়া কথা হয়ও না; হবেও না এই দেশে।

মূল্যস্ফীতি কত অঙ্কে পৌঁছেছে, তা নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-আমলার সঙ্গে দায়িত্বশীল অর্থনীতিবিদদের তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বাজারে গেলে বোঝা যায়, কত টাকায় কত চাল, কত ডিম, কত মাংস আর কত কী! ৩০ দিনের বেতনে ২০ দিনও চলে না। দিনের রোজগারে কুলায় না তিন বেলার পারিবারিক আহার। বাজারের সেই মর্মান্তিক সত্য সরকারি বয়ানের মধ্যে থাকা বিরাট বিরাট ফুটো দিয়ে হারিয়ে যায়। দিনকাবারি আয়ের মানুষের কথা না-হয় বাদ দিলাম; মাসকাবারিদের অবস্থাও অভাবে টানটান– যে কোনো সময় ছিঁড়ে যায় যায় অবস্থা। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের কাছে সবই যেন পরিসংখ্যান। কারণ সামনে নির্বাচন…।

সামনে নির্বাচন। দেশ অভূতপূর্বভাবে আন্তর্জাতিক কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে। বিদেশিরা আসছেন-যাচ্ছেন আর বাণী দিচ্ছেন। নেতানেত্রীরাও বিদেশে যাচ্ছেন আর আসছেন এবং আত্মবিশ্বাসের বেলুন ফুলিয়েই চলেছেন। কতটা ফোলালে বেলুনটা ফাটবে না– সেই হুঁশটাও নেই অনেকের। জনগণ হয়ে পড়েছে মিনিমাগনার বাণীভোক্তা। সেসব বাণীর দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি, কী আছে জাতির ললাটে। কীসে বেশি ভুগব আমরা তা ভাবতে ভাবতে কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। কোনটা বেশি ভয়াবহ– ডেঙ্গু জ্বর, জিনিসপত্রের নাগালছাড়া দাম, নাকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা? যেন কোনো হিংসুটে অপদেবতা আমাদের সামনে তিনটি বিপদের কার্ড ছুড়ে দিয়ে বলছেন, ‘বাছারা, বেছে নাও যার যার সর্বনাশের রাস্তা!’ অথচ বেছে নেওয়ার সুযোগও অধিকাংশের নেই। বেশির ভাগ মানুষ নিয়তিবাদী হয়ে পড়ছে। কারণ পরিণতি তাদের জানা নেই; ভাগ্য ছাড়া সহায় নেই। যখন সহায় থাকে না; পরিণতি জানা থাকে না; তখন নিয়তিবাদ জেঁকে বসে মনে।

সরকার সহায় হতে পারছে না। সরকার ব্যস্ত বিদেশি চাপ সামলাতে। আরও একবার ক্ষমতায় আসার রাস্তা তৈরি ছাড়া আর কিছু তারা ভাবছে বলে মনে হয় না। ৩০০ জন সংসদ সদস্যসহ সরকারি দলের অন্তত হাজারখানেক নেতা আগামী নির্বাচনে দাঁড়ানোর টিকিট পেতে মরিয়া তদবিরে ব্যস্ত। ডেঙ্গু মোকাবিলা নয়; অর্থনীতি পুনরুদ্ধার নয়; তাদের চাই এমপি পদের মনোনয়ন। এমন সংকট ও সম্ভাবনার জটিল দিনে জনপ্রতিনিধিদের সময় কোথায় জনগণের খবর রাখার!

‘এ মৌসুমে ডেঙ্গুতে এক লাখের বেশি আক্রান্ত এবং পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে (২৩ আগস্ট ২০২৩)।’ ২০২০-২১ সালের করোনা মহামারিতে অনেকের পারিবারিক ছবির কেউ কেউ ‘মৃত’ হয়ে গেল। বন্ধু-প্রতিবেশী-সহকর্মীর কতজন শহর ছেড়ে গেল, কাজ হারাল! কতজন অনুজ আত্মহত্যা করল! আমরা তবু ঘুরে দাঁড়ানোর জেদ ছাড়িনি। কারণ ওই জেদটুকুই মানুষ। পরের দিন ভালো করার আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো দূরের কথা, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়লাম বৈশ্বিক মন্দায়। ইউক্রেন যুদ্ধের কুবাতাসে উবে গেল অনেকের সচ্ছলতা।

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে বিপদ আসে মাকড়সার মতো আট পা নিয়ে। গরিবের কথা কী বলব, করোনাকালের নাজুক হয়ে পড়া মধ্যবিত্ত ইজ্জত ঢাকতে পারলেও ক্ষুধা ঢাকতে পারছে না। বাজারে সব আছে; শুধু দামের লাগামটা যে কার হাতে, বোঝা মুশকিল। চাল-তেল দিয়ে শুরু হয়ে এখন ডিম-চিনি হয়ে আবার চালের বাজার নিয়ে ভয় জাগছে। কাঁচামরিচের আমদানিও দেখতে হলো। মজুতদারদের অতিমুনাফাগিরি না থামিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী শুধু আমদানিতে সমাধান খোঁজেন। তাই তাঁকে আমদানিমন্ত্রী বলাই ভালো। অথচ ঋণখেলাপিরা কী নির্ভয়! ব্যাংক লোপাট, অর্থ পাচারের পরও উদারহস্তে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। মওকুফ করছে ঋণের সুদ।

কোনটা খারাপ সময়? যখন খারাপ লোকেরা সাহসী কিন্তু ভালোর দাবিদাররাও উদাসীন? সরকার না-হয় গদি রক্ষায় ব্যস্ত। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বিরোধী দল বিএনপি, তাদের মুখেও তো সরকারের পতন বিনা কথা নেই। ডেঙ্গুতে ভুগে পাঁচশরও বেশি মানুষ মারা গেলেন। আরও অনেকে আছেন অপেক্ষমাণ তালিকায়। অভাবের তাড়না, বেকারত্বের জ্বালায় কতজন চিমসে গেলেন। মেধাবী তরুণরা হতাশায় নিয়মিত আত্মহত্যা করছেন। বিরোধী দল বিবৃতি আর অভিযোগ করেই খালাস।

আশ্চর্যজনকভাবে বিএনপির বক্তৃতা-বিবৃতি আর জমায়েতের স্লোগান থেকে জনদুর্ভোগের কথা অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারাও বিদেশিদের সঙ্গে তদবিরের রাজনীতি করছে। কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলা, দুরবস্থা মোকাবিলা বিকল্প প্রস্তাব কই? পথ বাতলানো কই? জিনিসপত্রের দামের কাছে হেরে যাওয়া মানুষের কষ্টের কথা বলে কতটা? মানুষের করুণ পরাজয়ের কষ্টটা কেন তাদের বক্তৃতার মাইক ফাটিয়ে বাজছে না? এক কেজি চালের দামের সঙ্গে এক ব্যাগ রক্তের প্লাটিলেটের দাম কত হওয়া উচিত, সেই দাবিদাররা কোথায়? অসহায় মানুষের কান্নার ডাকে তারা কি দৌড়ে আসছেন, যেভাবে ছুটে যেতেন মওলানা ভাসানী?

সরকারের ব্যর্থতা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে; সেটাই মূল কথা। কিন্তু যারা ক্ষমতার মূলে আসতে চান, তাদেরও প্রমাণ করতে হবে। শুধু আমরা ক্ষমতায় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে– বলাটা রূপকথা। ও-রকম রূপকথায় বিশ্বাস করার মন অন্তত দুর্যোগ, মহামারি, অভাবে ঝামা হয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের নেই। ছড়াকার সুকুমার রায় লিখেছিলেন, একটা পাগল আরেকটা পাষণ্ড। কে কোনটা, জানি না। কিন্তু মানুষ বড় কষ্টে আছে; মানুষ বড় কাঁদছে– এই কথাটা মানি।

ফারুক ওয়াসিফ: পরিকল্পনা সম্পাদক (সমকাল)

farukwasif0@samakal.com

শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



© ২০২৩ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। anusandhan24.com | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বে-আইনি, Design and Developed by- DONET IT