‘ইউনিফরম পরে শৌচাগারে যেতে অস্বস্তি বোধ করি’
প্রকাশিত : ০৭:২৩ অপরাহ্ণ, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার ৬০ বার পঠিত
রাজধানীর কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হলের মোড় থেকে চার্চের মোড়ের দিকে বাস, প্রাইভেটকার, সিএনজিসহ বিভিন্ন প্রকার গাড়ি একের পর এক আসছে আর হাতের ইশারায় যাওয়ার জন্য বলছেন, কখনো হাতের ইশারায় সব গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা এভাবেই সড়কে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় কনস্টেবল শুকলা বসুকে। তার ইশারায়ই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের পাশে সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রাল চার্চের সামনের সড়কে ছুটে চলা গাড়িগুলো।
ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শুকলার মতো অনেক নারী ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মিতই দেখা যায়। আট ঘণ্টার দীর্ঘ এই ডিউটিতে ট্রাফিক বক্সে নেই শৌচাগারের ব্যবস্থা। ফলে দায়িত্ব পালনকালে শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। এতে নারী ট্র্যাফিকরা বেশি বিপাকে পড়েন।
আরও পড়ুন: উচ্চশব্দে ডিউটি: কানে কম শোনা, হৃদরোগসহ নানা ঝুঁকি ট্রাফিকের
দায়িত্ব পালনের এক ফাঁকে শুকলা বলেন, ‘ট্র্যাফিক বক্সে জায়গা খুবই কম হওয়ায় শৌচাগার করতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়েই পাশের চার্চের শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়। তবে ইউনিফরম পরে যেতে অস্বস্তিবোধ করি।’
জ্যামের নগরী রাজধানী ঢাকার সড়কে যানবাহনের বিশৃঙ্খলা কয়েক দশক ধরে। শৃঙ্খলা আনতে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা চেষ্টা করলেও তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে প্রায় হাজারখানেক ট্র্যাফিক পুলিশ। পাঁচ দশক ধরে পুরুষ ট্র্যাফিক পুলিশ এই দায়িত্ব পালন করলেও ২০১৪ সাল থেকে সড়কের শৃঙ্খলা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে পুরুষের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছে নারী ট্র্যাফিক পুলিশ।
আরও পড়ুন: ব্যস্ত সড়কে ট্রাফিক পুলিশই বেশি ঝুঁকিতে
৮ ঘণ্টার দায়িত্ব পালনের এই সময়ে পুরুষ ট্র্যাফিক পুলিশের মতোই দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। এই সময়ে বসা কিংবা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা থাকলেও এখনো অনেক পুলিশ বক্সে নেই শৌচাগার। যেসব পুলিশ বক্সে এই ব্যবস্থা নেই সেখানে পুরুষ কিংবা নারী সব ট্র্যাফিক পুলিশকেই আশপাশের কোনো শৌচাগারে যেতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোড়ে পুলিশের নিজস্ব কোনো জায়গা না থাকায় শৌচাগার করা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও করলে সিটি করপোরেশন তা অনেক সময় ভেঙে ফেলে। আর নারী ট্র্যাফিক পুলিশদের দায়িত্ব দেওয়া হয় এমন স্থানেই যেই পুলিশ বক্সে শৌচাগার রয়েছে।
জানা গেছে, পুলিশে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ শুরু হয় ২০১৪ সালে। সেই বছর প্রথমবারের মতো নিয়োগ দেওয়া হয় ২৮ জন নারী ট্র্যাফিক সার্জেন্ট। এর মধ্য দিয়েই ২০১৫ সালে সড়কে পুরুষের পাশাপাশি ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে নারী ট্র্যাফিক পুলিশ কাজ করতে শুরু করেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৬ জন নারী ট্র্যাফিক সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্র্যাফিক বিভাগেই কনস্টেবল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদের কাজ করছেন ৪১ জন নারী পুলিশ সদস্য। এরমধ্যে ২৯ জন নারী ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ও ১২ জন কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুই শিফটে কাজ করেন তারা।
আরও পড়ুন: ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট দেখার কেউ নেই
শব্দদূষণ আর ধুলাবালির মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারী ট্র্যাফিক পুলিশকেও একই দায়িত্ব পালন করতে হয়। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় সব কিছু উপেক্ষা করেই সড়কে যানচলাচলের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ট্র্যাফিক পুলিশ বক্সে শৌচাগার না থাকা।
এছাড়া রাজধানীতে দ্বিতীয় শিফটে দায়িত্ব পালন করতে ঝুঁকি কম থাকলেও রাজধানীর বাইরের জেলায় ঝুঁকি রয়েছে নারী ট্র্যাফিক পুলিশের। তাদের এসব সমস্যার কথা বারবার বলার পর কিছু সমাধান হয়েছে বলে জানান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে পুরোপুরি প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ।
আরও পড়ুন : পুলিশে এগিয়েছে নারী
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে শারমিন আক্তার জাহানের বাড়ি। পরিবারের ছয় ভাই-বোনের মধ্যে শারমিন তৃতীয়। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেই আবেদন করেন পুলিশ সার্জেন্ট পদে। চাকরিও হয়ে যায় তার। সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বটি পুরুষের থেকে নারীদের জন্য আরও বেশি কঠিন। নানা সমস্যা যেমন রয়েছে, ঝুঁকিও রয়েছে অনেক পেশার চেয়ে বেশি। এসব ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান শারমিন।
শারমিন বলেন, সমস্যা যেসব আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
শব্দদূষণ, ধুলাবালির সমস্যা তো রয়েছেই; তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শৌচাগারের। আর রাজধানীর বাইরে রাতের বেলায় দায়িত্ব পালন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।
ট্র্যাফিক বক্সে কোনো শৌচাগার না থাকায় আশপাশের মার্কেট, হাসপাতাল বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয় সড়কে কর্মরত পুলিশদের। সন্ধ্যার পর এসব অফিস বা মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
সার্জেন্ট শারমিন আক্তার বলেন, শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি আমাদের ওয়াশরুমের সমস্যা। রাস্তায়ই আমাদের থাকতে হয়, তাই আমাদের বক্সগুলো যদি আরেকটু উন্নত করা হয় এবং ওয়াশরুম যদি বক্সের কাছে থাকে তাহলে আমাদের আর বাইরের রেস্টুরেন্ট, শপিংমলে, মার্কেট, হাসপাতাল এগুলোতে যাওয়া লাগে না। আমরা এসব জায়গায় ইউনিফরম পরে যেতে অস্বস্তিবোধ করি।
আরও পড়ুন: জাতিসংঘ মিশনেও সমুজ্জ্বল ‘দেশের নারী পুলিশ’
শুধু সার্জেন্টই নন, সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেন নারী কনস্টেবলরাও। নওগাঁ জেলায় বেড়ে ওঠা সাবিনা খাতুন ছোটবেলা থেকেই চাকরি করবেন এই ইচ্ছা ছিল। পুলিশের গাড়ি দেখে তার ইচ্ছা জাগে এই পেশার প্রতি। ২০১৫ সালে কনস্টেবল পদে যোগ দেন সাবিনা। ২০১৭ সালে আসেন ট্র্যাফিকের দায়িত্বে। এরপর ছয় বছর ধরে সড়কে ট্র্যাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ট্র্যাফিকে আসতে না চাইলেও এই দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামতেই ঢাকা মেডিকেলের চাঁনখারপুল মোড়ে ট্র্যাফিকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। হানিফ ফ্লাইওভারের ব্যস্ত যানচলাচলের এই সড়কে রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স যেমন চলে আবার সকালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষের থাকে বেশ চাপ। হাতের ইশারায় প্রতিদিন তাকে সামাল দিতে হয় হাজারো যানবাহনকে।
সড়কে নারী ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কতটা কঠিন জানতে চাইলে সাবিনা খাতুন বলেন, নারী বলে কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে কীভাবে কাজ করছি। আবার অনেকে অনেক কথাও বলে একটু জ্যাম লাগলেই। গাড়ির শব্দ, ধুলাবালি এসবের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে নারীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শৌচাগারের। আমাদের ট্রাফিক বক্সে যদিও শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু যেখানে নেই সেসব জায়গায় নারীদের জন্য খুব সমস্যা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শাহ আলম বলেন, ‘নারী ট্র্যাফিক পুলিশের জন্য শৌচাগার সমস্যার সমাধানে আমরা কাজ করছি। সড়কে পুলিশের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। শৌচাগার করার মতো জায়গা না থাকায় অনেক ট্র্যাফিক বক্সেই শৌচাগার করা যাচ্ছে না। যেসব জায়গায় শৌচাগার রয়েছে সেসব জায়গায় আমরা চেষ্টা করি নারী ট্র্যাফিক সদস্য যারা রয়েছে তাদের দায়িত্ব দেওয়ার। তারপরও কিছু কিছু জায়গায় যেখানে শৌচাগার নেই সেখানে অনেকে দায়িত্ব পালন করেন।’
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।