অভিযানেও চলছে অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্র
প্রকাশিত : ০৮:১৯ পূর্বাহ্ণ, ২০ জুন ২০২২ সোমবার ১৩৯ বার পঠিত
অভিযানের মধ্যেও প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলছে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বিভাগীয় শহরের বাইরে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না, তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে নজরদারি না থাকায় এই অরাজকতা চলছে।
অনেকদিন ধরে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসাবে ২৫ মে সারা দেশের অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ধারাবাহিকতায় ১৫ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪১টি অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফের রমরমা ব্যবসায় মেতে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১ ও ২ জুন রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। জেলার বাঘা উপজেলার সর্বাধিক ১১টি অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ ঘোষণা করে সিভিল সার্জন অফিস। তবে স্থানীয়রা শনিবার বিকালে জানিয়েছেন, এসব ক্লিনিকের বেশ কয়েকটি আগের মতোই চলছে। সিভিল সার্জন অফিস আর খোঁজ নেয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাঘায় অন্তত ১১টি অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় গেল ৫ বছরেও অধিকাংশ ক্লিনিক সরকারি নিবন্ধন পায়নি। ফলে ১ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাঘা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মঞ্জু ডিজিটাল সেন্টার, মাহমুদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাহমুদ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিক, উপশম মেডিকেল সেন্টার, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক, আইডিয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নাদিয়া ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফারিহা খেয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, খেয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল-মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়। তবে শনিবারও এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের সেবা দিতে দেখা যায়।
স্থানীয়রা আরও জানান, বন্ধ ঘোষণার তালিকায় আছে এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান মাইকিং করে রোগী ডাকছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বলছেন, তাদের ক্লিনিক বন্ধ হয়নি, চালু আছে। কেউ যেন বিভ্রান্ত না হন, এ জন্যই প্রচার চালানো হচ্ছে। রয়েল আলট্রাসাউন্ডের মালিক আব্দুল মালেক সরদারের দাবি, তার ক্লিনিকের বৈধ সব কাগজপত্র আছে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘অবৈধ ও বন্ধ ঘোষিত ক্লিনিকগুলোর অনেকে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। বাকিগুলো বন্ধ রয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। বন্ধের তালিকা প্রকাশের পরও কেউ যদি চালু রাখে, অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
খুলনায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বেল ভিউ ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বয়রা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রেডিয়েন্স আল্ট্রাসনোগ্রাফ, সিটি ম্যাক্স ক্লিনিক, সাউথ সিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযান অনিয়মিত হওয়ায় গোপনে চিকিৎসা দিচ্ছে এগুলোর অনেকেই। সরকারি হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে নিয়ে ব্যবসা করছে।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলেন, জেলা ও মহানগরীতে ১৩৬টি ক্লিনিকের মধ্যে ২১টি এবং ১৮৪ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ৪৩টি লাইসেন্সবিহীন। লাইসেন্স না থাকা এবং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি ৬৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা অভিযান বন্ধ করিনি। অবৈধ প্রতিষ্ঠান যেন কাগজপত্র ঠিক না করেই ফের চালু না করে, সেজন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপরও নজরাদারি বাড়াতে এই সপ্তাহ থেকে ফের অভিযান চালু হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. কাজী মোহাম্মাদ সালেহীন তৌহিদ বলেন, ১৫ জুন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে ২৮৬টি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২৭৩ ও দুই সিটি করপোরেশনে ১৩টি। একইভাবে চট্টগ্রামে ৩১১টি, রাজশাহীতে ২২২, রংপুরে ১১২, ময়মনসিংহে ১৯৩, বরিশালে ১২৬, সিলেটে ৫৮ এবং খুলনা বিভাগে ৩৩৩টি চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত ১১ হাজার ৮১টি বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে হাসপাতালের সংখ্যা ৩ হাজার ৭৬৩টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭ হাজার ১৫৬টি এবং ১৬২টি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে ২৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৬৪১টি অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৬ হাজার ৬০০টি নিবন্ধনের আবেদন করেছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৩টি নবায়নের জন্য একাধিকবার আবেদন করেছে।
এদিকে বৈধ চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে নিবন্ধনের আবেদন ও সিলগালা প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে হিসাব করে দেখা যায়, বর্তমানে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৫৯টি। অন্য বিভাগের মতো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে বন্ধ করে দেওয়া হাসপাতাল-ক্লিনিকের অনেকই ফের রোগীদের সেবা দিচ্ছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, নিবন্ধন ছাড়া যেসব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো অবৈধ। এসব খুঁজে বের করার জন্য জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে অধিদপ্তরে হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখায় প্রতিবেদন জমা দেবেন। এভাবে সহজেই বৈধ-অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্রের তথ্য পাওয়া সম্ভব। কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে আনা যাবে। না হলে সেখানে সেবা নিয়ে অসহায় রোগীরা বিপদে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শফিউর রহমান বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে কোনো অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক চালু করার সুযোগ দিচ্ছি না। যেগুলো চালু হচ্ছে, সেগুলো নিয়ম মেনে খুলছে। সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনরা পরিদর্শন করে আমাদের কাছে সুপারিশ পাঠাচ্ছেন। আমরা কাগজপত্র দেখে সঠিক মনে হলে সেগুলোর লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছি। তবে বিস্তারিত তথ্য পেতে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ভালো বলতে পারবেন বলে জানান।’
অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, মানুষের সেবার ক্ষেত্রে যত কাজই হোক, সবার আগে প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আমরা এখনো সন্তুষ্টির পর্যায়ে পৌঁছাতে পরিনি। যেসব অবৈধ বা নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। মনিটরিং ও জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। যেমন: নির্দেশনা দেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ৮০০-এ বেশি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক বন্ধ করা হয়েছিল। এই অভিযান চলমান রয়েছে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।