অভাবের শেষ নেই অসাধু ব্যবসায়ীর
প্রকাশিত : ০৫:৩৫ অপরাহ্ণ, ৩ জুন ২০২২ শুক্রবার ১৫৫ বার পঠিত
সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা এবং মজুতদারি রোধে ইসলামের নির্দেশনা নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশবরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও কুরআন গবেষক মাওলানা শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন। তিনি জামালী তালিমুল কুরআন সোসাইটির চেয়ারম্যান এবং রূপায়ণ টাউন সেন্ট্রাল মসজিদের খতিব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূর আহমাদ
বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়েও ইসলামের আছে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথম কথা হলো, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য কেনাবেচার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। বিক্রেতা ভেজালমুক্ত পণ্য নায্যমূল্যে বিক্রি করবেন এবং ক্রেতা দেখেশুনে দরদাম করে সঠিক মূল্যে ক্রয় করবেন। এ দুটি বিষয় ব্যাঘাত হচ্ছে কিনা তা তদারকির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস থেকে জানতে পারি, রাসূল (সা.) যখন মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, তিনি প্রায়ই বাজারে গিয়ে নিজে মেজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করতেন। কখনো কখনো প্রতিনিধি পাঠিয়েও বাজার তদারকি করতেন। বাজার স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে হুজুরের (সা.) নীতি ছিল কঠোর। একবার তিনি একটি গম মতান্তরের খেজুরের বস্তায় হাত ঢুকিয়ে দিলেন। ভেতরে ভেজা পণ্য দেখে রাসূল (সা.) দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, ওপরে ভালো শস্য ভেতরে কেন ভেজা? দোকানি বলল, মানুষ ভেজা শস্য নিতে চায় না, তাই এমনটি করেছি। রাসূল (সা.) বললেন, যে ব্যবসায়ী ক্রেতাকে ঠকায় সে আমার উম্মত নয়। এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঠকবাজ ব্যবসায়ী কতটা ঘৃণিত ছিল নবিজির চোখে। পাশাপাশি এটাও প্রমাণিত, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
বাজার অস্থিতিশীলকারীদের সম্পর্কে কুরআন কী বলেছে?
: পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কথা ছিল আমাদের আচার-আচরণ দেখে বিশ্বের মানুষ ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হবে। কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ বাস্তবায়নের দিক থেকে আমরা হব অগ্রগামী। আফসোস! কুরআন পড়তেই জানি না আমরা। সুন্নাহ কি তাও বুঝি না। আজান হলে দৌড়ে মসজিদে যাই, রমজান এলে সকাল থেকে সন্ধ্যা না খেয়ে কাটিয়ে দিই, পয়সা হলে কাবা ঘুরে আসি-এভাবেই আমরা হয়ে গেলাম লোক দেখানো মুসলমান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘কিছু মানুষ দাবি করে, আমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী। কিন্তু ওরা আদৌ বিশ্বাসী নয়। ওরা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ঠকাতে চায়। আসলে ওরা নিজেদেরই ঠকাচ্ছে, যদিও ওরা তা বোঝে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ৮-৯।) মুসলমান হতে হয় আচরণে, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে। আফসোস! আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে, মানুষের রক্ত চোষাই তাদের একমাত্র টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে দাম বাড়লে একটি কি দুটি পণ্যের দাম বাড়ত। এখন সব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট। পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াত থেকে জানা যায়, বাজার অস্থিতিশীল করার কারণে শোয়াইব নবির উম্মতকে আল্লাহতায়ালা চিরতরে ধ্বংস করে দেন। সূরা আরাফের ৮৫ থেকে ৯৩ আয়াত এবং সূরা হুদের ৮৪ থেকে ৯৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন আল্লাহতায়ালা।
মজুতদারি রোধে রাসূল (সা.) কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
: মজুতদারি রোধে রাসূল (সা.) বাজার মনিটরিং করতেন। শুধু তাই নয়, সময়ে সময়ে ব্যবসায়ী সমাজের উদ্দেশ্যে উৎসাহবোধক এবং ঠকবাজ ব্যবসায়ীদের নিন্দা করে নসিহত করতেন। মেশকাত শরিফের এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবি ও সিদ্দিকদের সঙ্গে।’ একইভাবে মজুতদারি প্রতিরোধে রাসূল (সা.) থেকে বেশ কিছু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ওইসব হাদিসে মজুতদারকে অভিশপ্ত ঘৃণিত পাপীষ্ঠ নরাধম বলা হয়েছে। মুসলিম শরিফের বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কেবল ঘোরতর পাপী ব্যক্তিই মজুতদারি করে থাকে।’ অন্য বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নিয়তে মজুতদারি করবে, সে পাপীষ্ঠ।’ (মেশকাত।) হজরত মাকিল বিন ইয়াসার (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি অসংখ্যবার রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, মুসলিম জনগণের জন্য পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যদি কেউ কোনো ধরনের কারসাজি বা সিন্ডিকেট করে তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে আগুনের চুল্লিতে বসিয়ে তার বিচার করবেন।’ (মেশকাত শরিফ।)
সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনায় আলেমদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
: আলেমরা দুই ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত তারা ব্যাপকভাবে সৎ ব্যবসায়ীর প্রশংসা এবং ঠকবাজ ব্যবসায়ীর নিন্দা সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করবে। জুমার খুতবা থেকে শুরু করে ওয়াজের ময়দান সর্বত্রই ইসলামের বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষকে জানাবে এবং সতর্ক করবে। এভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি একদল আলেম নিজেরা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, রাসূল (সা.), চার খলিফা, চার ইমামসহ সালফে সালেহিন প্রায় সবাই ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে ব্যবসার প্রবণতা নেই বললেই চলে। দেশের টপ বিজনেস ম্যানদের মধ্যে আপনি কোনো আলেম পাবেন না। আজ যদি শীর্ষ দশ ব্যবসায়ীর মধ্যে আলেমরা সংখ্যাগুরু হতো, তাহলে মুনাফাখোররা রোজার মাসে বা প্রয়োজনের সময় কারসাজি করে মানুষকে কষ্ট দিতে পারত না। আলেমদের সততার কাছে ব্যবসার জাহেলি সিন্ডিকেট ভেসে যেত। আফসোস! আমরা তা করতে পারিনি। এ ব্যাপারে প্রবীণ আলেমরা ভাববেন এবং তরুণ আলেমরা ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বলে আমি আশাবাদী।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে আপনার নসিহত কী?
: হে আমার মজুতদার ভাই! আল্লাহকে বেজার করে, আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিয়ে, মানুষের অভিশাপ কামিয়ে যে সম্পদের পাহাড় আপনি গড়ে তুলছেন, একটু ভাবুন কবরে এ সম্পদ কী কাজে আসবে! যে স্বজন-প্রিয়জনদের জন্য ইমান আমল বিকিয়ে জাহান্নামের আগুনের বান্ডেল পকেটে পুড়ছেন তারা কি আপনার আজাবের ভাগিদার হবে? অন্যের জন্য নিজের আখেরাত শেষ করবেন না। মনে রাখবেন, কাফনের কিন্তু পকেট নেই। আল্লাহর কাছে তাওবা করুন, মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে ফিরে আসুন। বাজার সচল রাখলে আল্লাহ আপনার জীবন সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে দেবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: noorahmadbangladesh22@gmail.com
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি anusandhan24.com'কে জানাতে ই-মেইল করুন- anusondhan24@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
anusandhan24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।